জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যে বেড়েছে

জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যে বেড়েছে

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

সরকারি হিসাবে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। তবে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অর্থাৎ খাবারের জন্য এখন মানুষকে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) রোববার সন্ধ্যায় মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

আগের মাস অর্থাৎ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। 

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও, খাদ্য মূ্ল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। 

জুলাই মাসে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের জুলাই মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের জুলাইয়ে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৬৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

আর ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের জুলাই মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের জুলাইয়ে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৭৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, কয়েক মাস টানা বেড়ে গত মে মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) সার্বিক মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ, ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠে। যা ছিল ছিল এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। 

জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে আসে। সবশেষ জুলাই মাসে আরও কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। 

তবে এই তিন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেনি, উল্টো বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। জুন মাসে তা বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। জুলাই মাসে তা আরও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশে উঠেছে।

গত ২০২২-২৩  অর্থবছরে ১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯  দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। 

তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। 

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।

 

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।  

শেষ পর্যন্ত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়েই শেষ হয় ২০২২-২৩  অর্থবছর। 

তবে, বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন কি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুলাই মাসে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার এখন বাংলাদেশের চেয়ে কম। 

বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়স সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।  

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি ছুঁটতে থাকে।

বিবিএসের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জুন ও মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬০ ও ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। 

জুলাইয়ে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।  

জুলাই মাসে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। 

এতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও শহর এলাকায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। তবে শহর ও গ্রাম-দুই জায়গাতেই খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। 

২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। এরপর ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।  

গত বছরের আগস্টে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। এর পর এপ্রিল পর্যন্ত এই সূচক ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। মে মাসে তা এক লাফে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠে।  

যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় গত অর্থবছরের পুরো সময় জুড়ে।  

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এ রকম এক সময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। 

ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়।  

যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। 

নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে।  

তবে রোজার মাসকে  সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকার কারণে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।  

এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। জুনে তা বেড়ে এক লাফে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে গিয়ে উঠেছিল।

মজুরি সূচক ৭.৫২ শতাংশ

বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।  

জানুয়ারিতে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।  

মার্চ মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয় ৭  দশমিক ১৮ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।  

মে মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। জুন মাসে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে উঠে। 

সর্বশেষ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বেড়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছে।

 

বীমার আওতায় আসছেন সরকারি চাকরিজীবীরা পরবর্তী

বীমার আওতায় আসছেন সরকারি চাকরিজীবীরা

কমেন্ট