সর্বকালের সর্বোচ্চ মজুত, তবু কমছে না চালের দাম
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ ৪৩ হাজার মেট্টিক টন ছাড়িয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহের ওপর ভর করে বেড়েছে এই মজুত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সরকারের গুদামে এত খাদ্য মজুত ছিল না।
ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ এবং ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানির চুক্তি রাশিয়া নবায়ন না করায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ে নতুন করে সংকট দেখা দেওয়ার মধ্যেই সর্বকালের সর্বোচ্চ মজুত গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুত ২০ লাখ ৪৩ হাজার মেট্টিক টন ছাড়িয়ে গেছে।
অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহের ওপর ভর করে বেড়েছে এই মজুত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সরকারের গুদামে এত খাদ্য মজুত ছিল না।
কিন্তু তার পরও বাজারে চালের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, ঢাকার বাজারে মোটা চালের দাম বাড়তি। টিসিবি বলছে, এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক শূন্য চার শতাংশ।
টিসিবি বলছে, এক মাস আগে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রোববার তা বেড়ে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। আর সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকায়। এক বছর আগেও এই দুই ধরনের চালের দাম একই ছিল।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সব মিলিয়ে ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৩ মেট্টিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৭ লাখ ৫১ হাজার ৮৬ টন, গম ১ লাখ ১৯ হাজার ৭০২ টন এবং ধান ১ লাখ ১১ হাজার ৯৬২ টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে ২০ লাখ ১০ হাজার টনে উঠেছিল। যা ছিল এত দিন রেকর্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সরকারিভাবে এত খাদ্যশস্য মজুত ছিল না। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত গত বছরের মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে। এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত; আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মজুত ১৯ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এর পর বেরো মৌসুম শুরু হয়; বোরোর বাম্পার ফলনে আমদানি ছাড়াই এখন প্রতিদিনই বাড়ছে মজুত। চলতি আগস্ট মাস জুড়েই চলবে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। মজুত আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
‘খাদ্য নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই’ জানিয়ে মন্ত্রী এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বিশ্বে যাই হোক না কেনো, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলেও আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমাদের প্রচুর খাদ্য মজুুত আছে। কিছু দিন পর আউশ ধান উঠবে। তার পর আমন ধান উঠবে। আগামী দেড়-দুই বছর আমাদের কোনো চিন্তা নেই।”
বর্তমান মজুতকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১২ লাখ ৫ হাজার ৩৩৩ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৬ টন ধান এবং ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩ হাজার ৫৪০ টন চাল।
চলতি অর্থবছরে কোনো চাল আমদানি হয়নি
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেড় মাস (১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট) পার হতে চলেছে; এই সময়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৪১০ টন গম আমদানি হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ টন চাল ও ৩৮ হাজার ৭৫ হাজার ১০০ গম আমদানি হয়।
বাম্পার ফলনেও কমছে না চালের দাম
আমনের পর বোরো ধানেরও বাম্পার ফলন হয়েছে দেশে। কিন্তু তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না। তবে গত এক-দেড় বছরে চালের দাম বাড়েনি; একই জায়গায় ‘স্থির’ আছে। মাস খানেক আগে মোটা চালের দাম কেজিতে ২/১ টাকা বেড়েছিল। এর পর আর বাড়েনি।
আমন-বেরোর বাম্পার ফলনের পরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “চালের দাম আসলে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কৃষক তো আর সরাসরি বাজারে চাল বিক্রি করেন না। বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে সেই ধান থেকে চাল করে বাজারে বিক্রি করে। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ঘটনা ঘটে, কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার বাজার ভালোভাবে মনিটর না করার কারণেই চালের দাম কমছে না।”
তিনি বলেন, “চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। সরকারি গুদামগুলোতে সাড়ে ২০ লাখ টন চাল মজুত রয়েছে। কৃষকের কাছেও প্রচুর চাল রয়েছে। কিছু দিন পর আউশ ধান উঠবে; তারপর আমনও উঠবে। সে কারণে এখন চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই।”
তিনি বলেন, “ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে-এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানোর পায়তারা করছে। ইতোমধ্যে বাড়ানোও শুরু করে দিয়েছে। তাহলে এক-দেড় বছর চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও হঠাৎ করে মোটা চালের দাম বাড়বে কেন?”
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আগামী এক-দেড় বছর আমাদের চাল নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমাদের যা মজুত আছে তা দিয়ে অনায়াসে এক বছর চলে যাবে। আউশের ভালো ফলন হবে বলে আমি সারা দেশে খবর নিয়েছি। সে কারণে ভারত কি করল, সেই অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের দাম না বাড়াতে পারে-তা এখনই শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে
বর্তমান মজুত খুবই ভালো। এটি যেকোনো আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হবে। পর্যাপ্ত মজুদের কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে সরকার বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে বলেও মনে জাহাঙ্গীর আলম।
গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সরকারি খাদ্য মজুদ ছিল ১৯ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমন ও বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। খাদ্যশস্য সংগ্রহও এখন পর্যন্ত ভালো হয়েছে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বোরো উৎপাদনের প্রাক্কলন এখনো প্রকাশ করেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বোরো মৌসুমের ধানের হিসাব ধরলে চলতি বছরে মোট উৎপাদন ৫ শতাংশ বেড়ে ৪ কোটি টন হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, এবার বোরোর ফলন হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ টন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
খাদ্য অধিদপ্তর মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান ও চাল কেনা শুরু করে। এ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারগুলো থেকে ১২ লাখ ৫ হাজার ৩৩৩ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তর ১৫ লাখ ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগস্ট পর্যন্ত শস্য কেনা অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশের বৃহত্তম ফসল বোরো। এটি দেশের বার্ষিক মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, “আমরা বোরো কেনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে আছি। তবে বিষয় এগুলো রাখবো কোথায়?”
ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি মজুত
খাদ্য অধিদপ্তরের ২১ লাখ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ক্ষমতা আছে। সরকারি খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির (পিএফডিএস) আওতায় খাদ্যশস্য সরবরাহ ৩ মাসের সমপরিমাণ শস্য নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এর ফলে সরকারি গুদামের কিছু জায়গা খালি হবে বলে জানান তিনি।
খাদ্যশস্যের বিতরণ কমে যাওয়া মজুদ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১৩ জুলাই পর্যন্ত মোট খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে ৩৩ হাজার ১০৫ মেট্রিক টন। গত বছরের একই সময়ে বিতরণ করা হয়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার টন।
খাদ্য অধিদপ্তরের মজুদ ও গুদাম বিভাগের পরিচালক জামাল হোসেন জানান, অন্যান্য খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যের কার্ডের আওতায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আগামী সেপ্টেম্বর শুরু হবে।
৩ মাসে সাড়ে ৪ লাখ টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “খাদ্যশস্যের বর্তমান মজুত স্বস্তি দেবে।”
১৩ লাখ টন মুজত থাকলেই যথেষ্ট
সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদের বর্তমান পরিমাণ সরকার নির্ধারিত ১৩ লাখ টনের চেয়ে বেশি উল্লেখ করে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাখাওয়াত বলেন, “আমরা আরও বেশি খাদ্যশস্য মজুদে রাখার পরিকল্পনা করছি।।”
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, “বর্তমানে মজুতের পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলোর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের জন্য ভালো অবস্থায় আছে।”
তার মতে, বাসমতী নয় এমন সাদা চাল রপ্তানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সরকারের উচিত চাল আমদানির বিকল্প দেশ খোঁজা, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমন উৎপাদন কমে গেলে তা পূরণে দ্রুত চাল কেনা যায়।
তিনি বলেন, “সামগ্রিক উৎপাদনের তুলনায় চালের ওপর বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা কম। ভারতের চাল রপ্তানির ওপর সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা দেশীয় চালের বাজারে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। তবে দেশের প্রধান ফসল ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ব্যবস্থা নিতে হবে।”
“সরকারি খাদ্য মজুতের দিক থেকে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। আগামী ৩ মাসের মধ্যে আমরা আরও একটি ফসল পাব। তবে সরকারের উচিত নিবিড়ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা, যাতে বাজার সংশ্লিষ্টরা দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নিতে পারে," যোগ করেন তিনি।
কমেন্ট