ভালো আছেন রংপুরের দিনমজুর ও শ্রমিকরা!
জুলাই মাসে একসময়ের মঙ্গাকবলিত উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের শ্রমিক-দিনমজুরদের মজুরি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম বেড়েছে রাজধানী ঢাকায় ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। ফাইল ছবি
সরকারি হিসাবে গত জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন খাতের দিনমজুর ও শ্রমিকদের সার্বিক মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর অর্থ হলো-২০২২ সালের জুনে শ্রমিক ও দিনমজুররা ১০০ টাকা মজুরি পেলে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পেয়েছেন ১০৭ টাকা ৫২পয়সা।
এর মধ্যে এই মাসে একসময়ের মঙ্গাকবলিত উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের শ্রমিক-দিনমজুরদের মজুরি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম বেড়েছে রাজধানী ঢাকায় ৫ দশমিক ২২ শতাংশ।
অর্থাৎ ২০২২ সালের জুলাইয়ে রংপুর বিভাগের শ্রমিক ও দিনমজুররা গড়ে ১০০ টাকা মজুরি পেলে গত জুলাই মাসে পেয়েছেন ১১১ টাকা ৩৪ পয়সা। আর ঢাকার শ্রমিক ও দিনমজুররা ২০২২ সালের জুলাইয়ে ১০০ টাকা মজুরি পেলে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পেয়েছেন ১০৫ টাকা ২২ পয়সা।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে হিসাব দিচ্ছে, তাতে দেখা যায়,বেশ কিছুদিন ধরেই রংপুর অঞ্চলের শ্রমিক ও দিনমজুররা অন্য বিভাগের শ্রমিক ও দিনমজুরদের চেয়ে বেশি মজুরি পাচ্ছেন। এই তথ্য সঠিক হলে, রংপুর বিভাগের দিনমজুর ও শ্রমিকরা সুখেই আছে বলা যায়।
তবে অর্থনীতির গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘এ তথ্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, কেউ বিশ্বাস করবে না। এটা অবিশ্বাস্য তথ্য।”
এআরএইচ ডটকমকে সেলিম রায়হান বলেন, “ঢাকার চেয়ে রংপুরের শ্রমিক-দিনমজুররা বেশি মজুরি পান, এটা কীভাবে সম্ভব? বিবিএসের গবেষণা পদ্ধতিতেই গোলমাল আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, এই দুই বছরের করোনা মহামারির পর দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে কোনো শ্রমিক-দিনমজুরেরই মজুরি বাড়েনি; তারপর আবার রংপুর বিভাগের দিনমজুর-শ্রমিকদের মজুরি রাজধানীর ঢাকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
“কিসের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো এই তথ্য পেয়েছে আমার কাছে বোধগম্য নয়।”
এ প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মতিউর রহমান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আমরা মাঠ পর্যায় থেকে যে তথ্য পাই, সেটাই প্রকাশ করি।”
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যায়, পাল্টে যায় সব হিশাব-নিকাশ। যার প্রভাব পড়ে মজুরি সূচকে।
এরপর ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেনে হামলার পর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। সেপ্টেম্বরে কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। সর্বশেষ জুলাই মাসে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
মে মাসে এই সূচক প্রায় ১০ শতাংশ, ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। জুন মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
কিন্তু এই কঠিন সময়েও মজুরি সূচক বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো মজুরি সূচকের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। নভেম্বরে বাড়ে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সর্বশেষ ডিসেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির সূচক ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস আগস্ট ও জুলাইয়ে এই হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮০ ও ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ দুই মাস জুন ও মে মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
সবশেষ গত তিন মাস মে, জুন ও জুলাই মাসে সার্বিক মজুরি সূচক ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩২, ৭ দশমিক ৩৯ ও ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।
বিবিএসের এই তথ্য বলছে, গত তিন মাসেই সার্বিক মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বেড়েছে। অথচ রাজধানী ঢাকায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে; ঢাকায় মে মাসে মজুরি সূচক ছিল ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। জুন ও জুলাই মাসে ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৫ ও ৫ দশমিক ২২ শতাংশ।
অপরদিকে রংপুরে মে, জুন ও জুলাই মাসে মজুরি সূচক ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৯, ১১ দশমিক ৪০ ও ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড় মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা খানিকটা কমে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও কমে ৬ দশমিক ১২ শতাংশে নেমে আসে।
অর্থনীতির পরিভাষায়, মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি হলে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। নিজেদের ক্রয়ক্ষমতা দিয়েই বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কেনা যায়।
সে হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি সূচক ২ দশমিক ১৭ শতাংশীয় পয়েন্ট কম হওয়ায় দিনমজুর ও শ্রমিকদের আয় বা মজুরি বাড়লেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। অর্থাৎ বাড়তি যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে বাজারে গিয়ে আগের মতো জিনিসসপত্র কিনতে পারছেন না। কেননা, এখনো মজুরি সূচকের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশ বেশি।
তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য সঠিক হলে রংপুর বিভাগের দিনমজুর ও শ্রমিকরা যে আয় করছেন বা মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেননা, ওই এলাকায় মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশ বেশি; ১ দশমিক ৬৫ শতাংশীয় পয়েন্ট।
এই তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির গবেষক সেলিম রায়হান বলেন, “পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্য সঠিক হলে, রংপুর বিভাগের দিনমজুর ও শ্রমিকরা সুখেই আছে বলা যায়।”
আর দেশের অন্যান্য এলাকার দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীরা যে বাড়তি আয় করছেন, তা দিয়ে সামাল দেয়া যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির চাপ। উল্টো আরও বেশি খরচের বোঝা চাপছে তাদের মাথায়। সব মিলিয়ে মানুষের সঞ্চয় বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। উচ্চবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সবাই কষ্টে আছেন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ছিল। তার আগের চার মাসেও একই চিত্র ছিল দেশে। সাধারণ সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে।
তবে অর্থনীতির এই পরিচিত প্রবণতায় ছেদ ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে।অর্থাৎ গত দেড় বছর ধরে দেশে সার্বিক মজুরি সূচক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই এ খাতে নিয়োজিত। আর ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
অন্যদিকে কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। শিল্প খাতের ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ, সেবা খাতের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত।
কোন বিভাগে মজুরি কত বাড়ল
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জুলাই মাসে ঢাকা বিভাগে মজুরি বেড়েছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। মে ও জুন মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৫ ও ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
জুলাই মাসে চট্টগ্রামে মজুরি বাড়ার হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। মে ও জুন মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮৫ ও ৭ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ।
রাজশাহীতে জুলাইয়ে মজুরি বাড়ার হার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। মে ও জুন মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ১৬ ও ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
রংপুর বিভাগে জুলাই মাসে দিনমজুর-শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। মে ও জুন মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৯ ও ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
বরিশাল বিভাগে জুলাই মাসে মজুরি সূচকের হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খুলনায় ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
আর সিলেট বিভাগে জুলাই মাসে মজুরি সূচকের হার ছিল ৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কমেন্ট