সরকারি গুদামে খাদ্য মজুত কমছে, নেমে এসেছে ১৮ লাখ টনে
মঙ্গলবার সরকারের গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭১১ হাজার মেট্টিক টন। অথচ ১০ দিন আগেও এই মজুত অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ২০ লাখ ৫০ হাজার টনে উঠেছিল। ফাইল ছবি
ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ এবং ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে নিরাপদে শস্য রপ্তানির চুক্তি রাশিয়া নবায়ন না করায় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ে নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যের মজুত কমতে শুরু করেছে।
বুধবার সরকারের গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৬ হাজার মেট্টিক টন। অথচ ১০ দিন আগেও এই মজুত অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রায় ২০ লাখ ৫০ হাজার টনে উঠেছিল।
বেশ কিছুদিন সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই চাল আমদানি না হওয়ায় এবং ৩০ টাকা কেজি দরে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিক্রি, ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) ও ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ অব্যাহত থাকায় খাদ্যের মজুত কমছে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান।
‘তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ জানিয়ে তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “সরকারি গুদামগুলোতে এখনও ১৮ লাখ টনের বেশি খাদ্য মজুত আছে। কৃষকের কাছেও প্রচুর ধান-চাল রয়েছে। কিছু দিন পর আউশ ধান উঠবে; তারপর আমনও উঠবে। সে কারণে চাল নিয়ে আগামী এক বছর আমাদের খুব একটা চিন্তা নেই।”
তিনি বলেন, “ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে-এই অজুহাতে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়ানোর পায়তারা করছে। আমাদের যা মজুত আছে তা দিয়ে অনায়াসে এক বছর চলে যাবে। আউশের ভালো ফলন হবে বলে আমি সারা দেশে খবর নিয়েছি।”
“সে কারণে ভারত কি করল, সেই অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের দাম না বাড়াতে পারে-তা শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, বুধবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। আর সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭২ টাকায়।
এক বছরের ব্যবধানে এই তিন ধরনের চালের দাম কমেছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯৭, ৮ দশমিক ৭০ ও ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার (২৩ আগস্ট) দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সব মিলিয়ে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৬৪৬ মেট্টিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩০ টন, গম ২ লাখ ৬ হাজার ৬২২ টন এবং ধান ৭৩ হাজার ২২১ টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে ২০ লাখ ১০ হাজার টনে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত গত বছরের মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে। এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়।
এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত; আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মজুত ১৯ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এর পর বেরো মৌসুম শুরু হয়; বোরোর বাম্পার ফলনে আমদানি ছাড়াই গত ১২ আগস্ট মজুত সাড়ে ২০ লাখ টনে গিয়ে পৌঁছে। চলতি আগস্ট মাস জুড়েই চলবে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। এরমধ্যে অবশ্য মজুত কমতে শুরু করেছে।
বর্তমান মজুতকে ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১২ লাখ ৯৪ হাজার ৩০১ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৬ টন ধান এবং ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৫০৫ টন চাল।
দুই মাসে কোনো চাল আমদানি হয়নি
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (১ জুলাই থেকে ২২ আগস্ট) সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩০ টন গম আমদানি হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ টন চাল ও ৩৮ হাজার ৭৫ হাজার ১০০ গম আমদানি হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বোরো উৎপাদনের প্রাক্কলন এখনো প্রকাশ করেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বোরো মৌসুমের ধানের হিসাব ধরলে চলতি বছরে মোট উৎপাদন ৫ শতাংশ বেড়ে ৪ কোটি টন হতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে, এবার বোরোর ফলন হয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ টন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
খাদ্য অধিদপ্তর মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কৃষকদের কাছ থেকে বোরো ধান ও চাল কেনা শুরু করে। এ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারগুলো থেকে ১২ লাখ ৮৬ হাজার ৭০ টন সংগ্রহ করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তর ১৫ লাখ ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগস্ট পর্যন্ত শস্য কেনা অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশের বৃহত্তম ফসল বোরো। এটি দেশের বার্ষিক মোট ধান উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি।
গত ১২ জুলাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিতে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ৬ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে গম আমদানি অব্যাহত আছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানির প্রস্তুতি বেশ ভালোভাবেই শুরু করেছিল। কিন্তু ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় আপাতত তা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
১৩ লাখ টন মুজত থাকলেই যথেষ্ট
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, “বর্তমানে মজুতের পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলোর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের জন্য ভালো অবস্থায় আছে।”
তার মতে, বাসমতী নয় এমন সাদা চাল রপ্তানির ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সরকারের উচিত চাল আমদানির বিকল্প দেশ খোঁজা, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমন উৎপাদন কমে গেলে তা পূরণে দ্রুত চাল কেনা যায়।
কমেন্ট