১৪ জেলা মিলে করিডোর জিডিপি ৩২ থেকে ২৮৬ বিলিয়নে নিয়ে যাবে: এডিবি

১৪ জেলা মিলে করিডোর জিডিপি ৩২ থেকে ২৮৬ বিলিয়নে নিয়ে যাবে: এডিবি

‘বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট হাইলাইটস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরেছে এডিবি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই করিডোর গড়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।

উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণপশ্চিমের ১৪ জেলা মিলে- খুলনা বিভাগ থেকে ঢাকা হয়ে উত্তরপূর্বে সিলেট ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত-বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ২০২০ সালের ৩২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২৮৬ বিলিয়ন ডলার হবে বলে জানিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। 

‘বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট হাইলাইটস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরেছে এডিবি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই করিডোর গড়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। 

বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ।   

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজার রহমান ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনের (বেজা) চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন। 

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এডিবির সিনিয়র কান্ট্রি স্পেশালিস্ট সুন চেন হং।   

স্বাগত বক্তব্য দেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যাডিমন গিন্টিং। আলোচনা করেন এডিবির পরিচালক সব্যসাচী মিত্র, প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক উজমা চৌধুরী ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ। সমাপনী বক্তব্য দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সদস্য অভিজিৎ চৌধুরী। 

অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি খাতগুলোর প্রতিনিধিরাও এতে অংশ নেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে এই করিডোর অঞ্চলের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার, করিডোর গড়ে উঠলে তা ২৮৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।

 

মূল প্রবন্ধে সুন চেন হং বলেন, ২০২৫ সালে নাগাদ এই করিডোর ২৩ লাখ অতিরিক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করবে। পর্যায়ক্রমে এই সংখ্যা বেড়ে ২০৫০ সাল নাগাদ ৪ কোটি ৭ লাখে উন্নীত হবে। 

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর (বিইসি) অঞ্চলে ১২ ধরনের প্রস্তুতকারক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যাবে। 

“কর্মচঞ্চল শিল্পাঞ্চলগুলোর সাথে শহুরে ক্লাস্টারগুলিকে যুক্ত করতে প্রধান প্রধান যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ধরে এই করিডোর অবকাঠামো নির্মাণের দরকার হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুবিধাভোগী জনসংখ্যাকে সর্বোচ্চ অংশগ্রহন করাও এর অন্যতম লক্ষ্য।” 

“বর্তমানে বাংলাদেশের সিংহভাগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ কেন্দ্র করে। সে তুলনায়, খুলনা, মোংলা, সিলেট, রংপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ অন্যান্য জেলা ও বিভাগ পিছিয়ে পড়েছে। ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বিকাশে অবদান রাখতে পারার মতো যথাযথ ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর ঘাটতিও আছে এসব অঞ্চলে।” 

সুন চেন হং বলেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবের পরও গত ১০ বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। এসময়ের মধ্যে বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। 

“এর পেছনের দুটি কারণের একটি হিসেবে কম উৎপাদন খরচের কথা তুলে ধরেন তিনি। অপরটি হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষাধিকার পাওয়া।”

 

স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে সুন চেন বলেন, এরপর থেকে বাংলাদেশের শ্রম সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধাও কমে যাবে। একইসময়ে তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্মের আবির্ভাব ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

“বিশেষ করে এসময়ের মধ্যে তৈরি পোশাক, চামড়ার মতো শ্রমঘন শিল্পে রোবোটিক্স ও অটোমেশন চলে আসবে।” 

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে অবস্থানগত সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার বিষয়টি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি। 

ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য বিভাগে পর্যাপ্ত ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি। 

এডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, “বর্তমানে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের প্রধান পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। এক্ষেত্রে খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত করিডোরটি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল খুলনা থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সিলেট এবং ময়মনসিংহ বিভাগকে যুক্ত করবে। এ অঞ্চলের স্থলবন্দরগুলো ভারতের সঙ্গে প্রধান বাণিজ্য প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে, যা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশ অবদান রাখে।” 

“একইভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো বাংলাদেশে রাবার, চুনাপাথর ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ রপ্তানি করতে পারে। আর নেপাল ও ভুটানকে এ করিডোরে যুক্ত করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।” 

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। 

পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক করিডোর হতে পারে দুইটা। একটা হতে পারে খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে সুনামগঞ্জ। আরেকটা পঞ্চগড় থেকে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার টেকনাফ পর্যন্ত। এই দুটি করিডোরই হবে অর্থনীতির মেরুদণ্ড। 

তবে করিডোর দুটো ঢাকাকে কেন্দ্র করে হওয়ায় ঢাকার যানজট এটির পথে প্রধান বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে তার আশংকা। এ বাধাকে তিনি হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেন।

 

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “আমি মনে করি মাঝখানে ঢাকা একটি হিমালয়ের মতো বাধা হতে পারে। এজন্য ঢাকার চতুর্দিকে বাইপাস করতে হবে। সরকারের কাজ হবে ঢাকার চতুর্দিকে কোথায় কীভাবে বাইপাস করতে হবে তা ঠিক করা।” 

তিনি বলেন, “এ দুই করিডোরের দুটি বড় কাজ আমরা ইতোমধ্যেই করে ফেলেছি। একটি হচ্ছে উত্তরের জন্য করেছি বঙ্গবন্ধু সেতু আর সাম্প্রতিককালে আমাদের পদ্মাসেতু।” 

এম এ মান্নান বলেন, “দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য এটা আমাদের সরকারের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ডায়নামিক মানুষ। তিনি চান যে আরও বেশি করি আরও তাড়াতাড়ি করি।” 

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক করিডোরের কাজ বেশি চলছে উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “প্রতিবেশীর সঙ্গেই বেশি ভালো সম্পর্ক থাকবে এটা অন্যায় কিছু নয়।” 

হাওড় এলাকা সুনামগঞ্জের এই সাংসদ বলেন, দুই করিডোরের একটির উন্নয়নে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হাওড়ের ওপর দিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত ফ্লাইওভার হচ্ছে। এছাড়া খুলনাকে কেন্দ্র করে কলকাতাসহ পশ্চিমবাংলা আবার পঞ্চগড়ের পশ্চিমে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডোর হতে পারে। 

“আবার সিলেট দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টারে বিশাল অর্থনৈতিক এলাকা আছে। সুতরাং সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াবো কেন। কানেক্টিভিটি শুধু আমাদের ভেতরে নয়, বাইরেও আমাদের নিয়ে যাবে।” 

“রাজনীতিবিদরা সীমা-টিমা নির্ধারণ করেন নানা কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্য সীমা মানে না।” 

নিরাপত্তাজনিত কারণ ছাড়া আরও বেশি উদারতা নিয়ে সীমান্ত খুলে অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি করতে পারলে মানুষের আরও আয়ের পথ তৈরি হবে বলে মনে করেন এম এ মান্নান। এতে চোরাচালানও কমে আসবে বলে তার আশা। 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন অর্থনৈতিক করিডোর শুধু দেশের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলেন। তা বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে তিনি মনে করেন। 

কৃষিভিত্তিক শিল্প, পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার পাশাপাশি পুরো অঞ্চলটি উন্নত বাজার হিসেবেও তৈরি হবে বলেও তার মত। 

এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং বলেন, “একটি অর্থনৈতিক করিডর সমন্বিত উন্নয়নের এমন এক অনুঘটক-যা অবকাঠামো শক্তিশালী করে, শিল্পের বিস্তারকে সক্ষম করে,  কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে শহুরে ও সামাজিক সমষ্টির সাথে সংযুক্ত করে এবং দেশের উন্নত এলাকা থেকে দূরে উন্নয়নকে বিকেন্দ্রীকরণ করে।” 

নতুন অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার পরবর্তী

নতুন অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার

কমেন্ট