সর্বজনীন পেনশন: প্রবাস স্কিমে সাড়া কম, প্রণোদনা দেওয়া হতে পারে
বহুল আলোচিত এই কর্মসূচি চালুর আট দিনে দেড় কোটি প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন মাত্র ২০৯ জন। ফাইল ছবি
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ‘প্রবাস’ স্কিমে সাড়া একেবারেই কম। বহুল আলোচিত এই কর্মসূচি চালুর আট দিনে দেড় কোটি প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন মাত্র ২০৯ জন।
বিষয়টিকে ‘হতাশাজনক’ চিহ্নিত করে এই স্কিমকে ঘিরে নতুন করে ভাবা হচ্ছে সরকারের দিক থেকে। দেশে প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা দেওয়া হতে পারে এ পেনশন কর্মসূচির চাঁদার বিপরীতেও।
বর্তমানে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ প্রবাসীরা ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরও ২ টাকা ৫০ পয়সা যোগ হয়ে মোট ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন।
‘প্রবাস’ স্কিমের চাঁদার বিপরীতেও একই হারে প্রণোদনা দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র।
গত জুলাইয়ের সরকারি হিসাবে ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন; কর্মসূচিটি তাদের জন্য।
দেশের নাগরিকদের পেনশনব্যবস্থার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালু করছে সরকার। গত ১৭ আগস্ট বহুল প্রতীক্ষিত এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর থেকেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি উন্মুক্ত হয়েছে সবার জন্য।
পেনশন কর্মসূচি বা স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন চাঁদাদাতা। তবে চাঁদাদাতা মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে চাঁদাদাতার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত হতে যত বছর বাকি থাকত, সেই সময় পর্যন্ত নমিনি পেনশন উত্তোলন করতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিম, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’ স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য ‘সুরক্ষা’ স্কিম আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘সমতা’ স্কিম।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে জারি করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা; আর গঠন করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ‘ইউপেনশন’ নামক ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে। এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, ১৭ আগস্ট থেকে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) পর্যন্ত আট দিনে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে চাঁদা দিয়েছেন মোট ৮ হাজার ২৩১ জন। এদের মধ্যে প্রগতি কর্মসূচির আওতায় ৪ হাজার ৩৭১ জন, সুরক্ষায় ২ হাজার ৭৪১, সমতায় ৯১০ ও প্রবাস কর্মসূচিতে চাঁদা দিয়েছেন মাত্র ২০৯ জন।
এদিকে নিবন্ধনের পর চাঁদা দিলে অন্য তিন কর্মসূচি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হলেও সমতা কর্মসূচির ক্ষেত্রে তা হতে একটু দেরি হবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করার পরই তা চূড়ান্ত হবে। তবে চূড়ান্ত না হলেও এ কর্মসূচির আওতায় পরের মাসের চাঁদা দেওয়া যাবে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় কেউ কোনো ভাতা পেয়ে থাকলে এ কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়া যাবে না। সমতা কর্মসূচিটি দরিদ্র মানুষের জন্য, যাঁদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। এ কর্মসূচিতে চাঁদার অর্ধেক টাকা দেবে সরকার।
তাই কোনো ভাতাভোগী যাতে এ কর্মসূচিতে যুক্ত না হন, সে জন্যই মূলত যাচাই-বাছাই করা হবে।
সমতা কর্মসূচিতে চাঁদার হার একটিই, আর তা হচ্ছে ৫০০ টাকা। প্রতি চাঁদা দাতার বিপরীতে সরকার অনুদান দেবে আরও ৫০০ টাকা করে।
সমতা কর্মসূচিতে ১৮ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ৪২ বছর কেউ চাঁদা দিলে ৬০ বছরের পর থেকে চাঁদা দাতা মাসিক পেনশন পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে।
চাঁদা দেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গেই চুক্তি করেছে পেনশন কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনের পর অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে।
সেবা দেওয়ার কাজটিকে আরও সহজ ও মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ভবিষ্যতে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গেও চুক্তি হওয়ার আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে তিন দিন আগে দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সঙ্গে জুম বৈঠক করেছে পেনশন কর্তৃপক্ষ। ডিসিদের বলা হয়, এ কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে।
পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা জানান, নিবন্ধন অনেকেই করছেন। কিন্তু নিবন্ধনকে আমরা আমলে নিচ্ছি না। আমরা দেখছি, প্রকৃতপক্ষে চাঁদা দিয়েছেন কতজন। চাঁদা দাতাই হচ্ছে প্রকৃত হিসাব, নিবন্ধনকারী নয়। আগ্রহীদের অনেকে নিবন্ধন করা যাচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্যও নিবন্ধন করেন।
জমা হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পেনশন ফান্ড বা তহবিলে চার স্কিমে প্রথম মাসের চাঁদা হিসেবে সব মিলিয়ে ৫ কোটি টাকার বেশি জমা হয়েছে।
বয়সের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ-যুবকরাই সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৪০ বছরের লোকজন বেশি। এই স্কিমে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় ঢাকা বিভাগের লোকজন বেশি নিবন্ধন করেছেন।
প্রগতি স্কিমের আওতায় গ্রাহকদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত চার কোটি জমা হয়েছে পেনশন ফান্ডে। আর এই স্কিম গ্রহণের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
বিনিয়োগ ভালো জায়গায় না হলে চ্যালেঞ্জিং হবে
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “নিঃসন্দেহে সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে এটার প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিনিয়োগ পলিসি, পরিচালন সবকিছু মিলিয়ে একটা অর্গানোগ্রাম তৈরি করতে হবে। পেনশনের জন্য মানুষের দেয়া টাকার বিনিয়োগ নিশ্চিত হতে হবে।”
“বিনিয়োগ ভালো জায়গায় না হলে এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। এই ফান্ড যেন যেনতেনভাবে যেকোনো জায়গায় সরকারের ইচ্ছেমতো ব্যয় না হয় সেদিকে কঠোর তদারকি করতে হবে। বিনিয়োগটা যাতে লাভজনক হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে।”
পেনশন ফান্ড ব্যবহারে নীতিমালা হচ্ছে
সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে পেনশন ফান্ড ব্যবহার করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করছে অর্থবিভাগ। খুব শিগগিরই এই নীতিমালা তৈরি করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করবে সরকার। এতে করে গ্রাহকদের আস্থা আরও বাড়বে।
পেনশন ফান্ডের টাকা কোথায় কিভাবে ব্যবহার হবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যারা স্কিমে ঢুকতে চান তাদেরও আগ্রহ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হয়ে পড়া, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নানা সময়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
এ ছাড়া সরকারি পেনশন পেতে নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ ধরনের নানা সমালোচনাও রয়েছে দেশে।
এ অবস্থায় সর্বজনীন পেনশন ফান্ডের টাকার সঠিক ব্যবহার এবং বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশ ও জাতিকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, এ তহবিলের টাকা ঝুঁকিমুক্ত খাতে বিনিয়োগ এবং লাভজনক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন ফান্ডের টাকা ব্যবহার ও বিনিয়োগ করা হবে। শুধু তাই নয়, পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালন ব্যয় সরকারের বিশেষ ফান্ড থেকে খরচ করা হবে। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে এই তহবিল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। যেসব বিনিয়োগে ঝুঁকি কম সেখানে বিনিয়োগ করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা এআরএইচ ডটকমকে বলেন, সব মিলিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে পেনশন তহবিলের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা হবে সে বিষয়ে একটি আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধি বা নীতিমালা তৈরি করা হবে।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে এই তহবিল সরকারি বন্ড বা ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। যেসব বিনিয়োগে ঝুঁকি কম সেদিকেই যাব। যদি ফান্ড আরও বড় হয় তা হলে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হতে পারে। এটা সময়ের পরিক্রমায় হবে। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরি হচ্ছে, সেই অনুযায়ী সব হবে।”
কমেন্ট