সর্বজনীন পেনশন: ১ মাসে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলেনি
বহুল প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর এক মাসে কিস্তির টাকা জমা দিয়ে বিভিন্ন স্কিমে নিবন্ধন নিয়েছেন ১২ হাজার ৯৭০ জন।
‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’ এ স্লোগানকে ধারণ করে প্রৌঢ় জীবনকে সুখে ভরাতে সরকারের নতুন কর্মসূচিতে আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলছে না।
বহুল প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর এক মাসে কিস্তির টাকা জমা দিয়ে বিভিন্ন স্কিমে নিবন্ধন নিয়েছেন ১২ হাজার ৯৭০ জন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা রোববার এআরএইচ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের মানুষকে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে সরকারের সর্বজনীন এই কর্মসূচি চালু করে সরকার।
গত ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
চার শ্রেণির নাগরিককে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এই কর্মসূচি।
পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন চাঁদাদাতা। তবে চাঁদাদাতা মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন চাঁদাদাতার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত।
অর্থাৎ কোনো চাঁদাদাতা যদি ৬০ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে তার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ বছর তার নমিনি পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের গত জারি করা সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী এ নিয়মই অনুসরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিধিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা। বিধিমালায় আজীবন পেনশনের ব্যাপারে অবশ্য স্পষ্ট কিছু বলা নেই।
অর্থ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, উদ্বোধনের দিন থেকেই ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছেন। ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবেন।
১৮ বছরের বেশি দেশের এই চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে যেমনটা সাড়া মিলবে বলে আশা করা হয়েছিল, প্রথম এক মাসে তেমনটি সাড়া মেলেনি।
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা বলেন, “এখন পর্যন্ত পেনশন স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৯৭০ জন। নিবন্ধন হিসাব করলে সংখ্যা অনেক বেশি হবে, তবে আমরা শুধু নিবন্ধনের হিসাব আমলে নিচ্ছি না। টাকা জমা দিয়ে আক্ষরিক অর্থে যারা যুক্ত হয়েছেন তাদের হিসাব নিচ্ছি।”
পেনশন স্কিমে সাড়া তুলনামূলক কম কি না জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, “এ ধরণের একটি প্রোগ্রামের জন্য এক মাস বেশি সময় না। যারা যুক্ত হয়েছেন তারা স্বতস্পূর্ত তাগিদে যুক্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে আরও প্রচারণা দরকার আছে।”
“আর একটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ স্কিম করার আগে তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাও হিসাব করছে। মানুষকে সময় দিতে হবে, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে এটা বাড়বে।”
পেনশনের টাকা পাওয়া নিয়ে কোনো আস্থার সংকট রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনারা যদি সিস্টেমটা দেখেন, পেনশন স্কিম গ্রহণকারীকে এখনও যেমন কোথাও যেতে হয় না, ভবিষ্যতেও যেতে হবে না। আবেদনে তিনি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দিয়ে দিচ্ছেন। তিনি যখন পেনশন পাবেন, তখন ইএফটি’র মাধ্যমে তার প্রাপ্য টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যাবে।”
“কোনো মানুষের সান্নিধ্যে যেহেতু আসা লাগছে না, তাই হয়রানির প্রশ্নই নেই। যখন স্কিম পূর্ণতা লাভ করবে, তখন অটো সিস্টেমে পেনশনের টাকা তার অ্যাকাউন্টে চলে যাবে।”
প্রবাস স্কিম, প্রগতি স্কিম, সুরক্ষা স্কিম এবং সমতা স্কিম- এ চার স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। চালুর প্রথম দিনেই এতে ব্যাপক সাড়া দেখা যায়। কিন্তু এক মাসে পেনশন স্কিমে ১৩ হাজার মানুষের যুক্ত হওয়া মোটেই সন্তোষজনক নয়।
পেনশন বিধিমালা বলো হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন প্রথায় যার যত টাকা জমা, মেয়াদ শেষে তার তত বেশি পেনশন।
অন্যদিকে, স্বল্প আয়ের মানুষদেরও বিমুখ করবে না এ উদ্যোগ। যারা মাসিক ৫০০ টাকা জমাবেন, তাদের জন্য শুরু থেকেই থাকবে সরকারের আরও ৫০০ টাকার ভর্তুকি। সবমিলিয়ে, সবার জন্যই থাকছে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বাড়তি কয়েকগুণ মুনাফা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পৃথিবীর বহুদেশেই চালু আছে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা। যেগুলো চলছে ঠিকঠাক। বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন খাতে জমা হওয়া অর্থ যাবে লাভজনক বিনিয়োগে, তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই জমা হবে স্কিমের হিসাবে। ফলে বেগ পোহাতে হবে না খুব একটা।
আর পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। যা সর্বজনীন পেনশন আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস করা হয়।
উদ্বোধনের পর জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট- www.upension.gov.bd চালু করা হয়েছে এবং চারটি স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকে টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে দেশে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন গ্রাহক। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন ১৫ বছর।
সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রয়েছে সমতা স্কিম।
এছাড়া পরবর্তী সময়ে শ্রমজীবী ও শিক্ষার্থীদের জন্য আরও দুই ধরনের প্যাকেজ চালু করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
উদ্বোধনের দিন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। ভবিষ্যতে গড় আয়ু আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতিক লভ্যাংশের আওতায় রয়েছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম। গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতার হার বাড়বে। এ কারণে একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, কোনো বৈদেশিক সাহায্য ও কারিগরি সহায়তা ছাড়াই এ ধরনের একটি বড় কাজ গুছিয়ে আনা হয়েছে। উদ্বোধনের পর থেকেই চারটি স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকে টাকা জমা শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে দেশ-বিদেশের বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে ভালো সাড়া পড়েছে।
পেনশন কর্মসূচি বা স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন গ্রাহক। গ্রাহক মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ৭৫ বছর বয়স হতে যত বছর বাকি থাকবে, সেই সময় পর্যন্ত নমিনি পেনশন তুলতে পারবেন।
১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবেন। তবে আজীবন বা ন্যূনতম ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেতে কমপক্ষে একাধারে ১০ বছর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ওয়েবসাইটে (www.upension.gov.bd) গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। যেসব প্রবাসীর বাংলাদেশের এনআইডি নেই, তারা বৈধ পাসপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেল, অনুমোদিত মোবাইল আর্থিক পরিষেবা এবং এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিয়ে কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারবেন।
নিবন্ধনের পর একটি নম্বর পাওয়া যাবে, যা দিয়ে চাঁদা পরিশোধসহ সব কাজ করা যাবে। গ্রামীণ পর্যায়ে সহযোগিতা করবে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। এ কার্যক্রমকে আরও সহজ করতে শিগগির মোবাইল অ্যাপস চালু করবে পেনশন কর্তৃপক্ষ।
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য আরও দুটি স্কিম
উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আপাতত চার স্কিম শুরু হলেও আগামীতে আরও দুটি স্কিম চালু হবে।
এ বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আরও দুটি স্কিম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বর্তমানে তাদের পেনশন দেয় সরকার। তাই এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। চলমান চারটি স্কিম পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং সফলতার ভিত্তিতে ওই দুটি স্কিম চূড়ান্ত করা হবে।
পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর এ স্কিম দুটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে ২০৩১ সালের শুরুতে যারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করবেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন করা হতে পারে। তারা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় নির্ধারিত স্কিমে পেনশন পাবেন।
এ ছাড়া এর আগ পর্যন্ত সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা প্রচলিত নিয়মেই পেনশন পাবেন।
কমেন্ট