জুলাইয়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে গেছে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার
এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু কম সুদের এই ঋণ প্রবাহে দৈন্যদশা নিয়ে শুরু হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।
সরকারি হিসাবেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের (দুই অঙ্কের ঘরে, ডাবল ডিজিট) কাছাকাছি পৌঁছেছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমেছেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু কম সুদের এই ঋণ প্রবাহে দৈন্যদশা নিয়ে শুরু হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বুধবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যে ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে, তার থেকে প্রায় সাত গুণ চলে গেছে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই মাসে দাতা দেশ ও সংস্থারগুলোর কাছ থেকে ৪০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের জুলাইয়ে চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যার মধ্যে ৪৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলার ছিল প্রকল্প ঋণ বা প্রকল্প ঋণ। আর ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার ছিল অনুদান।
এই বছরের জুলাইয়ে অনুদান পাওয়া গেছে মাত্র ৫ লাখ ডলার।
অন্যদিকে এই জুলাই মাসে আগে নেওয়া ঋণের আসল-সুদ বাবদ মোট ২৭৫ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার (২.৭৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ৬৪ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সুদ-আসল বাবদ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থাকে ১৬৮ কোটি ডলার (১.৬৮ বিলিয়ন) পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ।
এই জুলাইয়ে আসল বাবদ শোধ করা হয়েছে ১৫৯ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার (১.৫৯ বিলিয়ন) ডলার। আর সুদ বাবদ শোধ করা হয়েছে ১১৫ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার।
গত বছরের জুলাইয়ে সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৬০ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। আর আসল শোধ করা হয়েছিল ১ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫৩ কোটি ৯০ হাজার ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল আরও কম ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের পর রিজার্ভের অন্যতম উৎস হচ্ছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণ কমে যাওয়া মানে রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে।
সবচেয়ে বেশি ঋণ ছাড় করেছে জাইকা
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই মাসে মোট ৪০ কোটি ৫৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার ঋণের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি-২৫ কোটি ১৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার দিয়েছে জাপানের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (জাইকা)।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ছাড় করেছে ৭ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বিশ্ব ব্যাংক ছাড় করেছে ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৪৬ লাখ ডলার। ভারত দিয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অন্যান্য দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
কম সুদের বিদেশি ঋণ এখন খুব প্রয়োজন
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বেশ কমে গেছে। এটা একটা উদ্বেগের বিষয়।”
“বিদেশি ঋণ-সহায়তা তেমন আসছে না। রেমিটেন্সও কমছে। এতে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। অর্থনীতিতে সংকট বাড়বে। সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”
সংকট কাটাতে কম সুদের বিদেশি ঋণ এখন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।
কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে।
দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীরা এখন বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোকে বেশি সহায়তা দিচ্ছে বিধায় বিদেশি ঋণ কমেছে।”
২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার
কমেন্ট