রাশিয়ার ‘বন্ধু’ তালিকায় বাংলাদেশ, লেনদেন করা যাবে রুবলে
শনিবার ঢাকায় রুশ দূতাবাস দেশটির সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে এ বিষয়ক ঘোষণায় দেশগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশসহ ৩১টি দেশের ব্যাংক ও ব্রোকারেজকে রাশিয়ার মুদ্রা বাজারে লেনদেনের অনুমোদন দিয়েছে দেশটির সরকার; একই সঙ্গে লেনদেন করা যাবে ডেরিভেটিভস মার্কেটেও।
ঢাকায় রুশ দূতাবাস এসব দেশকে ‘বন্ধুপ্রতীম ও নিরপেক্ষ’ বলে উল্লেখ করেছে।
শনিবার ঢাকায় রুশ দূতাবাস দেশটির সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে এ বিষয়ক ঘোষণায় দেশগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো হল- আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, ভিয়েতনাম, মিশর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাতার, চীন, কিউবা, মালয়েশিয়া, মরক্কো, মঙ্গোলিয়া, ওমান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, সার্বিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
ডেরিভেটিভ এক ধরনের আর্থিক চুক্তি যা দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে হয়ে থাকে। কিছুটা জটিল ধরনের এ চুক্তি-ডেরিভেটিভ ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট বাজারে অংশ নিয়ে বিভিন্ন সম্পদ লেনদেন করেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডেরিভেটিভ হিসেবে প্রচলিত সম্পদের মধ্যে রয়েছে মুদ্রা, স্টক, বন্ড, পণ্য, সুদের হার ও বাজার সূচক। ডেরিভেটিভ চুক্তির মান এসব সম্পদের দামের পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে।
ডেরিভেটিভের রকমফের হিসেবে সাধারণত বিবেচনা করা হয় এ চারটিকে- ফিউচার, ফরওয়ার্ড, সোয়াপ ও অপশন।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়া বিভিন্ন ধরনের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রয়েছে। ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করার সব ধরনের উপায় বন্ধ দেশটির। এতে আর্থিকভাবে চাপে পড়েছে দেশটি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভারত ও চীনসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালালেও মুদ্রা লেনদেনে জটিলতার মধ্যে রয়েছে।
অপরদিকে বেশ কয়েক বছর থেকে রুবল দিয়ে লেনদেনকে প্রাধান্য দিচ্ছে মস্কো, যা যুদ্ধের পর একমাত্র মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার উৎপাদিত তেল ও গ্যাস কিনতে রুবলে মূল্য পরিশোধের নিয়ম চালু করেন। এরপর থেকে রুবলে লেনদেন বাড়ছেও।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়া এমন সময়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন রুবল ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। মুদ্রা চাঙা করতে দেশটি সুদের হার ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়ার অর্থনীতিও চাপে রয়েছে, দুর্বল হয়েছে দেশটির মুদ্রা রুবল।
রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত নথিতে সই করেন। এর ফলে ৩১ দেশের ব্যাংক ও ব্রোকাররা রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে সরাসরি লেনদেন করতে পারবে।
রুবলের ক্রমাগত মূল্যপতন ঠেকাতে রাশিয়া এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
অবশ্য প্রকাশিত বন্ধু তালিকায় রাশিয়ার মিত্র হিসেবে পরিচিত আর্জেন্টিনা, হংকং, ইসরায়েল, মেক্সিকো ও মলদোভার মতো দেশগুলোর নাম নেই। জানা যায়, প্রাথমিকভাবে তাদের নাম রাখা হলেও চূড়ান্ত তালিকায় ওই দেশগুলো বাদ পড়েছে।
ইউক্রেনে হামলার পর যেসব দেশ মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের রাশিয়া ‘অবন্ধু’ হিসেবে মনে করে। যেসব দেশ মস্কোর বন্ধু ও নিরপেক্ষ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো মধ্য এশিয়ার দেশ, যারা একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এ ছাড়া অনেক দেশ দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার মিত্রদেশ হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন কোনো ব্যাংক রাশিয়ার মুদ্রায় লেনদেন করতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমতি দিতে পারে। তবে এখনো অন্য কোনো দেশে এমন কোনো ব্যবসা করছে না বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো।
আর দেশটির সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করতে চাইলে রুবলে নস্ট্রো হিসাব খোলার অনুমতি নিতে হবে। এরপর কেস-টু–কেস ভিত্তিতে অনুমোদন নিতে হবে।
বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিতে লেনদেনের ৯০ শতাংশের বেশি মার্কিন ডলারে হয়ে থাকে। এ ছাড়া ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, চীনা মুদ্রা ইউয়ান ও কানাডিয়ান ডলারে কিছু লেনদেন হয়ে থাকে।
এর বাইরে ভারতের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় গত ১১ জুলাই থেকে টাকা-রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রুপিতে রপ্তানি আয় থাকলেই কেবল রুপিতে আমদানি করা যাচ্ছে।
চলতি বছর বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়া এবং এর দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে রাশিয়ার তেল রাজস্ব কমেছে। তবে গত বছর দেশটির আমদানি কমে যাওয়ার কারণে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২১ বিলিয়ন ডলারে।
এ ছাড়া গত জুন মাসে পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে দেশটির অনেক মানুষ বিদেশি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। এসব কারণে রুবলের দরপতন হচ্ছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, রাশিয়ার অর্থনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের কারণে দেশটির নীতিপ্রণেতাদের পক্ষে কিছু করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই নীতিপ্রণেতারা যুদ্ধ শুরুর পরপর বেশ দক্ষতার সঙ্গেই পরিস্থিতি সামলেছিলেন।
কিন্তু শুধু স্বল্পমেয়াদি নয়, আরও অনেক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও আছে, যেগুলো মোকাবিলা করতে গিয়ে তারা এখন রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
এ ছাড়া বাজেট-ঘাটতি ও নিষেধাজ্ঞার কারণে রপ্তানি কমে যাওয়ায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভারসাম্য অনেকটাই বিনষ্ট হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস, চলতি বছর মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে; এতে বোঝা যায়, চ্যালেঞ্জ ঠিক কতটা।
তবে জুলাই মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বলছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
রাশিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘মস্কোর বন্ধু ও নিরপেক্ষ দেশগুলোর জাতীয় মুদ্রা সরাসরি রুবেলে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটির আরও উন্নত করা এবং ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরাসরি রুবলের মাধ্যমে লেনদেন করে রাশিয়ান অর্থনীতির চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সরকার এই তালিকা প্রকাশ করেছে।’
রাশিয়ার বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ মস্কো এক্সচেঞ্জ জানায়, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে দিরহাম-রুবল বিনিময়ের মাধ্যমে ফরেন এক্সচেঞ্জ লেনদেন শুরু করা হবে।
রাশিয়ার ডেপুটি ফাইন্যান্স মিনিস্টার অ্যালেক্সি মোইসেভ বুধবার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রুবল ব্যবহারে নিজস্ব নীতিমালার উপর রাশিয়া অটল থাকায় এতদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মস্কো আংশিকভাবে ‘জিম্মি’ হয়েছিল।
কমেন্ট