বাংলাদেশের ঋণমান ‘নেতিবাচক’: ফিচ রেটিংস

বাংলাদেশের ঋণমান ‘নেতিবাচক’: ফিচ রেটিংস

ফিচ-এর রেটিংয়ে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ এত দিন ছিল স্থিতিশীল। কিন্তু এখন তারা তা কমিয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘নেতিবাচক’ ঋণমান নির্ধারণ করেছে।

আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি’র পর আরেকটি ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছে। সংস্থাটি বাংলাদেশের ঋণমান ‘স্থিতিশীল’ থেকে 'নেতিবাচক' অবস্থানে নামিয়ে এনেছে। 

ফিচ-এর রেটিংয়ে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ এত দিন ছিল স্থিতিশীল। কিন্তু এখন তারা তা কমিয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘নেতিবাচক’ ঋণমান নির্ধারণ করেছে।  

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই রেটিং সংস্থাটি আগের মতোই বাংলাদেশের বিবি মাইনাস (বিবি-) রেটিং বজায় রেখেছে। তবে ফিচ রেটিংস সতর্ক করে বলেছে যে, দৃষ্টিভঙ্গি এখন ‘স্থিতিশীল’ না হয়ে ‘নেতিবাচক’। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ ধারায় নেমেছে। 

সোমবার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাতেই বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে দেওয়া ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ রেটিং দিয়েছে ফিচ রেটিংস। 

সংস্থাটি বাংলাদেশের আইডিআর (লং টার্ম ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং) রেটিং করেছে বিবি মাইনাস। বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নেগেটিভ বা নেতিবাচক। 

গত ২৫ জুলাই বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিল আরেক আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর'স (এসঅ্যান্ডপি)। এসঅ্যান্ডপিও বাংলাদেশের ঋণমান ‘স্থিতিশীল’ থেকে 'নেতিবাচক' অবস্থানে নামিয়ে এনেছিল। 

তার আগে ৩০ মে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর কথা ঘোষণা করে। তখন প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন ব্যাপক দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি আছে; একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও প্রতিভাত হচ্ছে। এ কারণে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়েছে।  

মুডিস আরও বলেছিল, পরিস্থিতি খানিকটা সহজ হলেও বাংলাদেশে ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যার কারণে দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত আছে। 

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে কমতে বেশ চাপের মধ্যে এসেছে পড়েছে। আর এতেই দেশটির অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ হয়েছে বলে সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ফিচ রেটিংস।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ শতাংশ কমেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ সঞ্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। প্রায় সাড়ে চার মাসের আমদানির খরচ মেটানোর রিজার্ভ থাকবে। 

তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে যে রিজার্ভ জমা থাকবে তা দিয়ে আড়াই মাসের  কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। 

প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম উল্লেখ করে এই অনুপাত বাড়াতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়ে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) রাজস্ব খাতের সংস্কারের জন্য যে সব পরামর্শ দিয়েছে তা অনুুসরণ করা কথা বলা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়বে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাবের বিষয়টি তুলে ধরে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

তবে এত হতাশার মধ্যেও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি আশার পূর্বাভাস দিয়েছে ফিচ রেটিংস। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ অর্জিত হবে। 

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর ভর করে রপ্তানি আয় বাড়ার কারণে এই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে হবে বলে জানিয়েছে ফিচ রেটিংস। 

১৯১৩ সালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ফিচ। ওইসময় প্রতিষ্ঠানটি শিল্প বিনিয়োগের জন্য অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নিয়ে ‘দ্য ফিচ স্টক অ্যান্ড বন্ড ম্যানুয়াল’এবং ‘দ্য ফিচ বন্ড বুক’ নামের দুটো প্রকাশনা বের করতো। 

এরপর ১৯২৪ সালে কোম্পানিটি রেটিং কার্যক্রম শুরু করে। 

বর্তমানে বিশ্বের ত্রিশটির বেশি দেশে কার্যক্রম চালু রয়েছে ফিচের; যৌথভাবে যার মালিকানায় রয়েছে প্যারিসভিত্তিক ফিমালাক এস এ এবং নিউইয়র্ক ভিত্তিক হার্টস কর্পোরেশন। 

মুডি’স ঋণমান আমলে নেননি গভর্নর 

তবে মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমালেও সেটাকে আমলে নেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “এই রেটিং কমানোর বিষয়ে আমাদের বিশেষ কিছু আসে যায় না। এটা করার পেছনে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।”

 

১৮ জুন ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় এক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।  

তার আগে ৩০ মে ছয় মাস আগে শুরু করা পর্যালোচনার তথ্যের ভিত্তিতে মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়; আগের বিএ৩ থেকে কমিয়ে বি১ এ নামিয়ে আনা হয়। 

রেটিং সংস্থাটির মূল্যায়ন অনুযায়ী, বৈদেশিক লেনদেন ও তারল্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে। এর সঙ্গে চলমান সংকটকালে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও দেখা গেছে। যে কারণে সর্বভৌম ঋণমানের রেটিং কমিয়ে বি১ করা হয়েছে।  

এ বিষয়ে গভর্নরের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এর আগে মুডি’স যে রেটিং দিয়েছিল, সেটা ২০১২ সালের দিকে। সে সময় আমাদের অর্থনীতি যেমন ছিল, তার চেয়ে এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ইতোমধ্যে আমাদের ডলারের রিজার্ভ বা মজুত ৪৮ বিলিয়নেও উঠেছিল। মাথাপিছু আয়ও গত কয়েক বছরে বেড়েছে। কিন্তু তখন তারা আমাদের রেটিং বাড়ায়নি।”  

“যেসব কারণে এখন রেটিং কমানো হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। যেটা করা হয়েছে সেটাকে পিওর ইকোনমিক রিপোর্টিং বলা যাবে না। এটা ভূরাজনৈতিক কারণে হয়েছে।  

“আমাদের রেটিং কমানোর মতো কিছু হয়নি। এখন দেশের অর্থনীতিতে ডলারের সংকট ও রিজার্ভের সমস্যা ছাড়া বড় কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া অর্থনীতির অন্য সূচকগুলো ভালো আছে।”

রাশিয়ার ‘বন্ধু’ তালিকায় বাংলাদেশ, লেনদেন করা যাবে রুবলে পরবর্তী

রাশিয়ার ‘বন্ধু’ তালিকায় বাংলাদেশ, লেনদেন করা যাবে রুবলে

কমেন্ট