রিজার্ভ নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

রিজার্ভ নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

ভারতে জি টোয়েন্টির শীর্ষ সম্মেলন এবং জাতিসংঘের ৭৮ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে শুক্রবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেছেন।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে আসায় এই সূচকটি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে।

রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বিরোধী দল রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করছে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা সরকারের সমালোচনা করছেন; সেইসঙ্গে আর যাতে না কমে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোও রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কথা বলছে। স্থানীয় গণমাধ্যমেও সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে অর্থনীতির এই সূচক।

তাইতো সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতে জি টোয়েন্টির শীর্ষ সম্মেলন এবং জাতিসংঘের ৭৮ তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে শুক্রবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবারই সাংবাদিকরা সমসাময়িক আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন, যার ব্যতিক্রম হয়নি এদিনও।

একজন গণমাধ্যমকর্মী সরকারপ্রধানের কাছে প্রশ্ন রাখেন বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ নিয়ে। রিজার্ভের পতন আর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী- এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বলেন রিজার্ভ কমার কারণ।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের মহামারিতে আমাদের আমদানি বন্ধ ছিল, রপ্তানি বন্ধ ছিল, যোগাযোগ বন্ধ ছিল, যাতায়ত বন্ধ ছিল, সব কিছু বন্ধ ছিল। যার কারণে আমাদের রিজার্ভ বেড়েছিল। এর পর যখন অর্থনীতি খুলে গেলে আমাদের সমস্ত জিনিস আমদানি করা শুরু হল, স্বাভাবিকভাবে রিজার্ভ কমবে, এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।”

দুইশ ডলারের গম ছয়শ ডলারে কিনতে হচ্ছে, আটশ ডলারের পরিবহন ব্যয় তিন থেকে চার হাজার ডলার লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তার পরেও সেটা পাওয়াও যাচ্ছে না।”

দেশের মানুষকে অন্ধকারে না রেখে ‘ভালো রাখতে গিয়ে’ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানতে চান রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে পণ্য আমদানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আগের অবস্থায় নিয়ে যাবেন কি না।

তিনি বলেন, “দেশের মানুষকে এখন যদি বলেন অন্ধকারে রেখে রিজার্ভ রক্ষা করতে হবে, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেই? পানি দেওয়া বন্ধ করে দেই? সার বন্ধ করে দেই? তাহলে রিজার্ভ ভালো থাকবে।”

সব বন্ধ করে রিজার্ভ বাড়াতে হবে কি না সে প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “আমার রিজার্ভটা বেশি রাখা প্রয়োজন না দেশের মানুষকে আরাম, ভালো মন্দ… মানুষের জন্য কাজ করা, কোনটা প্রয়োজন?”

বাংলাদেশ ব্যাংক সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার। আর গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।

তার সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে।

এ হিসাবে এক সপ্তাহে বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১০ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’হিসাবে কমেছে ১৯ কোটি ডলার।

১৪ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

৭ সেপ্টেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে।

গত ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথামতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘গ্রস’হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম৬ পদ্ধতি অসুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই দিন ‘গ্রস’রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

এর পর থেকে রিজার্ভ কমছেই। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসে ‘গ্রস’রিজার্ভ কমেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসাবে কমেছে আড়াই বিলিয়ন ডলার।

সবশেষ গত জুলাই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে বর্তমানের ২১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

তবে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের কম।

বুধবার ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের (আইবিএফবি) বার্ষিক সম্মেলনে এ তথ্য দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, “দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। ব্যালান্স অব পেমেন্টে বা লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার নিট মজুত কমে ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।"

শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় রিজার্ভ কত ছিল, সে প্রশ্ন রেখে তিনি সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “তার আগে তো অনেক আতেলরা ক্ষমতায় ছিল, জ্ঞানীগুণীরা ক্ষমতায় ছিল। রিজার্ভ কত ছিল?

“এক বিলিয়নও ছিল না, ০.৭৭ বিলিয়ন (৭৭ কোটি) ছিল। আমি যখন ১৯৯৬ এ ক্ষমতায় আসি তখন কত ছিল? আড়াই মিলিয়ন; যেটুকু বেড়েছে আমাদের সরকারের আমলেই বেড়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সে জন্যই আমি দেশবাসীকে আহ্বান জানাই, এক টুকরো জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। আমরা নিজেরা উৎপাদন করব, নিজেরা খাব, মানুষ কিন্তু করছে।”

রিজার্ভ নিয়ে নানা জনের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “রিজার্ভ নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে, আমি তো বলছি যে ঠিক আছে, যখন সরকার গঠন করেছিলাম তখন রিজার্ভ যত ছিল, ওইখানে রেখে তারপরে আবার নির্বাচন করব। পড়ে আবার বাড়াব। কিন্তু ওই খানে নিয়ে এসে দেখাব যে এই ছিল।”

সেটি করলে কী হবে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বিদ্যুৎ শতভাগ থেকে কমিয়ে ২৮ ভাগে নিয়ে এসে দাঁড় করাব। সবাই একটু টের পাক যে কী ছিল।

“বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে বলেছিলাম যেন প্রতিদিন একটু করে লোডশেডিং দেয়। তাহলে মানুষের একটু মনে থাকবে যে লোডশেডিং আছে। প্রতিদিন তেল কিনে জেনারেটর চালাতে হবে তখন আবার আক্কেলটা ঠিক হবে, যে এই অবস্থায় ছিল।”

বিদ্যুতে ভর্তুকি কেন দেবেন, সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে সবাই আর ভর্তুকির সুযোগটা নিচ্ছে সব অর্থশালী বড়লোকরা। সেখানে একটা স্লট ঠিক করব এত পর্যন্ত সাধারণ মানুষের এক দাম, আর তার থেকে বেশি তাদের জন্য আরেক দাম।”

ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি স্লট করে করে দাম নির্ধারণ করতে। যে বেশি ব্যবহার করবে তাকে বেশি দামে কিনতে হবে।”

রিজার্ভের পতন, বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমালোকদের বক্তব্যে তাদেরকে এক হাত নেনও শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “বেশি কথা বললে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব। নির্বাচনের পরে আসতে পারলে আবার করব। তারপরে দেখি কে সাহস পায় ক্ষমতা নিতে।”

“সব গোছাইয়া গাছাইয়া দেওয়ার পরে এখন নির্বাচনের কথা, ভোটের কথা পাকা পাকা কথা শুনতে হয়। আমি এত কথা শুনতে রাজি না। আমি এই দেশে আজকে না, ৭৭ বছর বয়স। ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে মিছিল করি। তাহলে আমার রাজনীতির বয়স কত? বাবা মা ভাই বোন সব হারিয়েছি, আমার হারাবার কিছু নেই।

“আগে বাংলাদেশ শুনলে সবাই নাক সিটকাত, এখন বাংলাদেশ শুনলে আলাদা মর্যাদার দৃষ্টিতে তাকায়, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখে।

“এটা মাথায় রাখতে হবে, এটা বাতাসে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এটা করেছি। একটা স্বপ্ন পূরণ করা যেটা জাতির পিতার ছিল,” বলেন শেখ হাসিনা।

বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে, কমেছে ছাড় পরবর্তী

বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে, কমেছে ছাড়

কমেন্ট