বিদেশি ঋণের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে সুদ-আসল শোধে
চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ৪০ কোটি ডলারের যে সুদ-আসল শোধ করা হয়েছে, তারমধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ২৫ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ডলার। আর সুদ শোধ করা হয়েছে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যে বিদেশি ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে, তার অর্ধেকেরও বেশি চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৃহস্পতিবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকুলে ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে।
এর মধ্যে ৪০ কোটি ডলার চলে গেছে আগের ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি, ৫৪ দশমিক ১৯ শতাংশ চলে গেছে সুদ-আসল পরিশোধে।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণ-সহায়তা কমেছে ১৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই দুই মাসে দাতাদের কাছ থেকে ৮৬ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৮৩ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার এসেছিল প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। আর অনুদান পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার ডলার।
আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে দাতাদের কাছ থেকে ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ৭০ হাজার ডলারের যে ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৭২ কোটি ৭২ লাখ ৪০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য; অনুদান এসেছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েছে ৩৮.২০%
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ৪০ কোটি ডলারের যে সুদ-আসল শোধ করা হয়েছে, তারমধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ২৫ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার ডলার। আর সুদ শোধ করা হয়েছে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
গত অর্থবছরের এই দুই মাসে ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার সুদ-আসল শোধ করা হয়েছিল। যার মধ্যে আসল ছিল ১৯ কোটি ৬৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর সুদ ছিল ৯ কোটি ২৮ লাখ ডলার।
এ হিসাবেই চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ৩৮ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি অর্থ চলে গেছে।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমেছেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু কম সুদের এই ঋণ কমছে। তবে, আশার কথা হচ্ছে-আগামীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতিও বাড়িয়েছে দাতারা।
ইআরডির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ১১৪ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার (১.১৪ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল ৩০ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দাতাদের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ২৭৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বিদেশি ঋণ খুব প্রয়োজন এখন
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলেও রেমিটেন্স প্রবাহ বেশ কমে গেছে। এটা একটা উদ্বেগের বিষয়।”
“বিদেশি ঋণ-সহায়তা তেমন আসছে না। রেমিটেন্সও কমছে। এতে রিজার্ভ কমছেই। অর্থনীতিতে সংকট বাড়ছে। সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”
সংকট কাটাতে কম সুদের বিদেশি ঋণ এখন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।
কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই চলতি অর্থবছর শুরু হয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
কমেন্ট