ভোটের আগে মূল্যস্ফীতি কমাতে নানা পদক্ষেপ
সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে গত কয়েক দিনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ও নীতি সুদহার বেশ খানিকটা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার বদলে এখন পরিশোধ করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। সরকারি হিসাবেই গত সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের সেপ্টেম্বরে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৬৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
আর ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের সেপ্টেম্বরে তা কিনতে ১১২ টাকা ৩৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
এই তথ্যই বলছে, দেশের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বিশেষ করে গরিব মানুষ ও নিম্মমধ্যবিত্তরা খুবই কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন। কেননা, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, সে অনুপাতে তাদের আয় বাড়েনি। অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।
এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চলে আসছে। আড়াই-তিন মাস পরই ভোট। এই ভোটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন বড় একটি ইস্যু হতে পারে—এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ভোটের মাঠের স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে গত কয়েক দিনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ও নীতি সুদহার বেশ খানিকটা বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ নেওয়ার বদলে এখন আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করছে।
মূলত বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতেই এ সব পদক্ষেপ নিচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডিসেম্বরের মধ্যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে এ সব পক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে আর ঋণ দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ খুবই সতর্ক অবস্থায় আছে। উল্টো সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বদলে এখন পরিশোধ করছে সরকার।”
মেজবাউল হক বলেন, "মূল্যস্ফীতি কমাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ফ্রেশ (প্রিন্টেড) মানি সরকারকে দিচ্ছে না। এর বদলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ধার করা বাড়িয়েছে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ধার কমাচ্ছে।"
‘দেরিতে হলেও ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ কমানোর পদক্ষেপকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, "সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সঠিক রাস্তাতেই আছে। সরকার গত অর্থবছরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে মূল্যস্ফীতি এত বাড়তো না। দেরিতে হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন যেসব পলিসি নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে।"
"অর্থবছরের শুরুর দিকে সরকারের টাকার চাহিদাও অবশ্য খুব বেশি থাকে না। তবে মনে হচ্ছে, আমরা এখন মানিটারি ও ফিসক্যাল দুই পলিসিতেই কন্ট্রাকশনারি (সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি) মুডে আছি। সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরকার। এজন্য সরকারকে এখন ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে।”
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতে বেশ কিছুদিন ধরে আমরা ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর কথা বলে আসছি। পৃথিবীর অনেক দেশ সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে—সে উদাহরণও আমরা বার বার দিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ৯ শতাংশ সুদহার আটকে রেখেছিল। সুদহার বাড়ালে বাজারে টাকার প্রবাহ কমে আসত; মূল্যস্ফীতি কমত।”
“যাইহোক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের বেশ খানিকটা বাড়িয়েছে। সেইসঙ্গে নীতি সুদহারও বাড়িয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি এখন নিম্মমূখী হবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা না করে, সেদিকেও সরকারকে কঠোর হতে হবে; কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না,,” বলেন আহসান মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২৯ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। এর জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ২৫ হাজার ৭০৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে।
এতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ কমেছে ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকের বাইরে থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা।
এতে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ বেড়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
হিসাব বলছে, এই তিন মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের জুন শেষে ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। আর জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের সুদ ব্যয় কমাতে নানা কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমেছে। এই চাপ সামাল দিতে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে; যা মূল্যস্ফীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিতে সরকারকে পরামর্শ দেয়। সে কারণেই সরকার এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ না দিয়ে উল্টো শোধ করছে।
এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪০১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ হিসাবে এই দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।
এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাহলে বলা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ হাজার ৫৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে নিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাচ্ছে।
পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।
ঋণের সুদহার আরও বেড়েছে
স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ৫ অক্টোবর ব্যাংক ঋণের সুদের হার আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একদিন আগে ৪ অক্টোবর নীতি সুদহারও আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে।
এক জরুরি সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এখন থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) এর সাথে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ এর স্থলে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।
চলতি অক্টোবর মাসের জন্য ৭ দশমিক ২০ শতাংশ ‘স্মার্ট’ সুদহার নির্ধারিত আছে। এর সঙ্গে আরও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ যোগ করে নতুন ঋণের সুদহার হিসাব করা হবে।
অর্থাৎ এখন থেকে বড় অংকের ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার হবে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে হ্রাস করার লক্ষ্যে নিচের নির্দেশনাগুলো পরিপালন করতে হবে-
>> ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট’ এর সাথে সর্বোচ্চ ৩% এর স্থলে সর্বোচ্চ ৩.৫% মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।
এবং
>> প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট’ এর সাথে সর্বোচ্চ ২% এর স্থলে সর্বোচ্চ ২.৫% মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।
৪ অক্টোবর অপর এক সার্কুলারে নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন এই সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিল।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমাতেই এ সব সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে এ সব পদক্ষেপের ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।”
কমেন্ট