সর্বজনীন পেনশন: প্রথম মাসে সাড়া মিললেও দ্বিতীয় মাসেই ভাটা

সর্বজনীন পেনশন: প্রথম মাসে সাড়া মিললেও দ্বিতীয় মাসেই ভাটা

বহুল প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর দুই মাস পূর্ণ হয়েছে সোমবার। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে এ সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন।

‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’ এ স্লোগানকে ধারণ করে প্রৌঢ় জীবনকে সুখে ভরাতে সরকারের নতুন কর্মসূচিতে আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলছে না।

বহুল প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর দুই মাস পূর্ণ হয়েছে সোমবার। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে এ সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন। এক মাসের মধ্যেই এ কর্মসূচিতে জনগণের আগ্রহ কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

তাই দেশব্যাপী এ কর্মসূচি জনপ্রিয় করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তার উপায় বের করতে সোমবার দেশের সব জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কর্তৃপক্ষ।

পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত চার স্কিমের আওতায় মোট ১৪ হাজার ৬৫৯ জন প্রথম কিস্তির টাকা জমা দিয়ে নিবন্ধন শেষ করেছেন। এতে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে ১১ কোটি ৫২ লাখ ৬১ হাজার টাকা।

প্রথম মাস শেষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৯৭০ জন প্রথম কিস্তির ৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জমা দিয়ে নিবন্ধন শেষ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় মাসে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৬১ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে যারা প্রথম মাসে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের একটি অংশের দ্বিতীয় কিস্তির টাকাও রয়েছে।

এক মাসের ব্যবধানে এ কর্মসূচিতে আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান সরাসরি উত্তর দেননি।

দুই মাসে মোট কতজন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করেছেন মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে মঙ্গলবার বিকেলে তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ফোনে কিছু বলা যাবে না। অফিসে আসেন বিস্তারিত জানাব।”

তিনি শুধু বলেন, “দেশ ও দেশের বাইরে সর্বজনীন পেনশন স্কিম আরও জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।”

সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের সব মানুষকে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে সরকারের সর্বজনীন এই কর্মসূচি চালু করে সরকার।

গত ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।     

চার শ্রেণির নাগরিককে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এই কর্মসূচি।   

পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন চাঁদাদাতা। তবে চাঁদাদাতা মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন চাঁদাদাতার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত।    

অর্থাৎ কোনো চাঁদাদাতা যদি ৬০ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে তার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ বছর তার নমিনি পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

জানা গেছে, সোমবার পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য প্রগতি স্কিমে সর্বাধিক ৬ হাজার ৬৬৩ জন কিস্তি পরিশোধ করে নিবন্ধন করেছেন। এ ক্ষেত্রে টাকা জমা হয়েছে ৬ কোটি ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’নামের স্কিম। কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ৫ হাজার ৯৩৮ জন ব্যক্তি তাদের কিস্তি পরিশোধ করে নিবন্ধন করেছেন। এ স্কিমে জমা হয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫০০ টাকা।

অতিদরিদ্রদের জন্য ‘সমতা’ স্কিমে কিস্তি বাবদ ৩৪ লাখ ৫০ টাকা জমা দিয়ে নিবন্ধন করেছেন ১ হাজার ৬৩৯ জন।

তবে প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিমে মাত্র ৪৪৪ জন এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এ স্কিমে ১ কোটি ৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা জমা হয়েছে।

পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এ উদ্যোগ আরও সফলভাবে বাস্তবায়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল (সোমবার) মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও স্থানীয় সরকার সচিবের উপস্থিতিতে দেশের সব ডিসি ও ইউএনওদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন তারা।”

“বৈঠকে যেসব সমস্যার কথা উঠে এসেছে, সেগুলো দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে।”

তিনি আরও বলেন, এর আগে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিভিন্ন বাধা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, পেনশন স্কিমের মত এত বড় কর্মযজ্ঞ চালু করার আগে অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, তার ওপর কোনো জরিপও হয়নি। এমনকি উদ্বোধনের পরও খুব একটা প্রচার নেই।

একই সঙ্গে এ কর্মসূচি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে দেওয়া হয় না। সার্বিকভাবে পরিষ্কর ধারণা জনগণকে দেওয়া না হলে এ উদ্যোগ সফলতা পাবে না।

তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচন সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে মানুষের আগ্রহের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এ কার্যক্রম যেহেতু আইন দ্বারা সুরক্ষিত, তাই টাকা খোয়া যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। স্কিম কোনো কারণে বন্ধ হলে সুদসহ অর্থ ফেরত পাবে জনগণ। তার পরও মানুষের মনে সন্দেহ হতেই পারে।”

গত ১৭ আগস্ট উদ্বোধনের কয়েক ঘণ্টা পর একসঙ্গে ১১ থেকে ১২ হাজার মানুষ অনলাইনে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্ল্যাটফর্মে ঢোকেন। প্রথম দিনই নিবন্ধন হয় ১ হাজারের বেশি। এর পর এক মাসে নিবন্ধনের সংখ্যা এবং অর্থ জমার পরিমাণ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট থাকলেও দ্বিতীয় মাসে কমে যাওয়ায় তারা কিছুটা চিন্তিত।

পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মানুষকে জানানোর জন্য জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নানা উপায় বেছে নিয়েছে। এর অন্যতম গণমাধ্যম। জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে টেলিভিশনে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে পেনশন স্কিমের ধারণা পরিষ্কার করা হচ্ছে।

বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গেও তারা কাজ করছেন। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসকদের যুক্ত করে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস করা হয়।

উদ্বোধনের পর জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট- www.upension.gov.bd চালু করা হয়েছে এবং চারটি স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকে টাকা দেওয়া শুরু হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন গ্রাহক। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন ১৫ বছর।

সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রয়েছে সমতা স্কিম।

উদ্বোধনের দিন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। ভবিষ্যতে গড় আয়ু আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতিক লভ্যাংশের আওতায় রয়েছে।  

দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম। গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতার হার বাড়বে। এ কারণে একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার।  

অর্থ মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছিল, কোনো বৈদেশিক সাহায্য ও কারিগরি সহায়তা ছাড়াই এ ধরনের একটি বড় কাজ গুছিয়ে আনা হয়েছে। উদ্বোধনের পর থেকেই চারটি স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকে টাকা জমা শুরু হয়েছে।

পেনশন কর্মসূচি বা স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন গ্রাহক। গ্রাহক মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ৭৫ বছর বয়স হতে যত বছর বাকি থাকবে, সেই সময় পর্যন্ত নমিনি পেনশন তুলতে পারবেন।  

১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যে কেউ পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও বিশেষ বিবেচনায় পেনশনভুক্ত হতে পারবেন। তবে আজীবন বা ন্যূনতম ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেতে কমপক্ষে একাধারে ১০ বছর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে।

এবারও হচ্ছে না আয়কর মেলা, কর অঞ্চলে সব সেবা পূর্ববর্তী

এবারও হচ্ছে না আয়কর মেলা, কর অঞ্চলে সব সেবা

‘দেশের ৪ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের মত’ পরবর্তী

‘দেশের ৪ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের মত’

কমেন্ট