শঙ্কা কেটে গেছে, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি মিলছে
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে জমা হবে এই ঋণ। তাতে রিজার্ভ যে চাপের মধ্যে রয়েছে তা কেটে যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শঙ্কা কেটে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাচ্ছে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে জমা হবে এই ঋণ। তাতে রিজার্ভ যে চাপের মধ্যে রয়েছে তা কেটে যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের শেষ বৈঠক হয়। পরে বৈঠক প্রসঙ্গে বিস্তারিত তুলে ধরেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, “আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত ছিল। এর মধ্যে ৬টি শর্ত নিয়ে কাজ করেছি আমরা। শর্তের বেশ কিছু সফল হয়েছে। কিছু পূরণ হয়নি। তবে শেষ বৈঠকে উভয়পক্ষ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হয়েছে।”
“এরই পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা যায়, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আমরা পাব। আগামী ১১ ডিসেম্বরে আইএমএফের বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। ওই মিটিংয়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন হবে বলে আশা করছি আমরা। ১১ ডিসেম্বরে আইএমএফ তাদের বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”
এদিকে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে একই কথা জানিয়েছে আইএমএফ।
বৈঠক শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিবৃতিতে সফররত আইএমএফ মিশনটি জানিয়েছে, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য প্রথম পর্যালোচনা শেষ করতে বিভিন্ন নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথম পর্যালোচনা শেষ হলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় কিস্তির জন্য ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ পাবে। আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
“বাংলাদেশে আসা মিশন তাদের প্রতিবেদন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য জমা দেবে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পর্ষদে তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।”
সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সমাপনী সভা করে। আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির এ পর্যালোচনা মিশন ৩ অক্টোবর দেশে আসে।
৪ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সভা করছে তারা। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এ সভার মধ্য দিয়ে মিশন শেষ হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “ঋণের জন্য আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি পূরণ হয়েছে। তবে রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণের শর্ত পূরণ হয়নি। এর পেছনে দেশীয় ও বৈশ্বিক যেসব কারণ আছে, সেগুলো আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এরপরই ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।”
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। ঋণ অনুমোদনের পর বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানায়, এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) বা বর্ধিত ঋণসুবিধা ও এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএএফএফ) বা বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার এবং নতুন গঠিত তহবিল রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় আরও ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
অনুমোদনের পরপরই ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশ ৪৭৬ মিলিয়ন বা ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পায়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আইএমএফের বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রথম কিস্তির রিভিউ সম্পন্ন করার জন্য যেসব নীতি গ্রহণ প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে আজ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আইএমএফ কর্মকর্তাদর বৈঠকে ঐকমত্য হয়েছে।”
বিবৃতিটি আইএমএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে আইএমএফর মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন, “কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকের এই সিদ্ধান্ত এখন আইএমএফ বোর্ডে তোলা হবে অনুমোদনের জন্য। প্রথম রিভিউ সম্পন্ন হলে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ), এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) এর আওতায় ৪৬ লাখ ২০ হাজার ডলার (কোটার ৩৩ শতাংশ) এবং রেসিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ২১ কোটি ৯০ লাখ ডলার (কোটার ১৫.৮ শতাংশ) ছাড় করা হবে।”
৪৭০ কোটি ডলারের এই ঋণ চুক্তি অনুমোদনের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ। ঋণের শর্ত হিসেবে বেশ কিছু আর্থিক ও নীতি সংস্কারে মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে।
এর মধ্যে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ব্যাংক ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী করে প্রকাশ, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ইত্যাদি।
প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি দেখে পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের জন্য আইএমএফ এর আর্টিকেল-ফোর এর অধীনে রিভিউ মিশনের প্রতিনিধি দলটি গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশে আসে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের সর্বশেষ বৈঠকে দ্বিতীয় কিস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছন, অর্থিক সংস্কারে নেওয়া বাংলাদেশের পদক্ষেপে আশ্বস্ত হয়েছে আইএমএফ রিভিউ মিশন। ঋণ চুক্তির ছয়টি শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। দুটিতে ব্যর্থতা থাকলেও তা দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে বাধা হবে না। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে নতুন কোনো শর্তও দিচ্ছে না আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে একক দরে নিয়ে আসা, মুদ্রানীতির আধুনিকায়ন, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব করার ক্ষেত্রে আইএমএফ এর পদ্ধতি অনুসরণ এবং রাজস্ব আদায় ও সুদহার বাজারভিত্তিক করা শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ।
“এর মধ্যে রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায় দুটিতে ঘাটতি রয়েছে। আমরা এর ব্যখ্যা দিয়েছি। কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে তা বলেছি। এতে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন।"
ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফিতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চেষ্টা থাকবে জানিয়ে মুখপাত্র বলেন, "প্রয়োজনে আবারও নীতি সুদহারে পরিবর্তন আসবে।"
সকালের ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। অন্যদিকে ১৩ সদস্যর আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ।
কমেন্ট