মূল্যস্ফীতি কমবে, রিজার্ভ বাড়বে: আইএমএফ
সেই সঙ্গে সংস্কারের অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়ে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ডিসেম্বরে ছাড় করার কথা বলেছে।
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—আইএমএফ।
সংস্থাটি বলেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসবে। আর বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়বে।
সেই সঙ্গে সংস্কারের অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়ে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ডিসেম্বরের মধ্যে ছাড় করার কথা বলেছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার যে নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, তাকেও স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশকে নিয়ে আইএমএফের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ হিসাবে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
আর বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ হিসাবে রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারের নিচে—২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ‘গ্রস’হিসাবে নেমেছে ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির পর্যালোচনা মিশন গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় আসে।
৪ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করছে মিশনের সদস্যরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সমাপনী বৈঠক করে বৃহস্পতিবার।
বৈঠকের পর পরই আইএমএফের বিবৃতিটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
তাতে বলা হয়, আইএমএফ মিশন ও বাংলাদেশ সরকার ঋণ কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করার বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে।
প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন হওয়ার পর এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি বা বর্ধিত ঋণ তহবিল (ইসিএফ) ও এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটির (ইএফএফ) আওতায় ৪৬ কোটি ২০ লাখ আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ২১ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় হওয়ার কথা।
অর্থাৎ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তিতে মোট ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় হতে পারে।
আইএমএফ প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার মিশনের সর্বশেষ দিনে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।
আইএমএফের প্রতিনিধিদলের প্রধান রাহুল আনন্দ বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ও আইএমএফের প্রতিনিধিদল ২০২৩ সালের আর্টিকেল ৪ পর্যালোচনা করেছে এবং ইসিএফ/ইএফএফ/আরএসএফের অধীনে প্রথম পর্যালোচনা সম্পন্ন করতে যেসব প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে। এ বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ের ঐকমত্য হয়েছে।
বাংলাদেশে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে অগ্রগতি হয়েছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদল তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার যে নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, তাকেও স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।
“এবারের আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিনিধিদল প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করবে। পর্ষদ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলে জানানো হয়েছে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) অর্জিত করতে পারে। অর্থবছরের শেষার্ধে (২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন) মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
অর্থনীতির আরেকটি স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে।
“তবে এই পূর্বাভাস ঘিরে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা আছে; ঝুঁকিও আছে,” বলা হয়েছে আইএমএফের বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, স্বল্প মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন মুদ্রা সরবরাহ আরও সংকুচিত করা এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাজস্ব নীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় করা।
স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া অর্থনীতি যেভাবে নানা কারণে ব্যাহত হচ্ছে, তার প্রভাব যেন অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর তেমন একটা না পড়ে, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ।
গত ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে। একে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।
বিবৃতিতে রাহুল আনন্দ আরও বলেন, “সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম, এই পরিস্থিতিতে টেকসইভাবে কর সংগ্রহ বাড়াতে সমন্বিত কর নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রয়োজন।”
এ ছাড়া ভর্তুকির যৌক্তিকীকরণ, ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে তিনি মনে করেন।
অর্থনীতির বহিঃস্থ খাতের ঝড়ঝাপটা মোকাবিলায় মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি কাঠামোর আধুনিকীকরণ এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি গুরুত্বপূর্ণ। সুদহারের ক্ষেত্রে করিডর ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একীভূত একক বিনিময় হার গ্রহণের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ।
সংস্থাটির পরামর্শ—এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদের হারের ‘টার্গেটিং ফ্রেমওয়ার্ক’পুরোপুরি চালু করাসহ ধীরে ধীরে নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থায় যেতে হবে।
এদিকে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইএমএফ।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হ্রাস করা, তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি করা, শাসনব্যবস্থা জোরদার করা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর উন্নতি করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে।
এ ছাড়া প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়ন অর্থায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সহায়তা করবে।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি অনুমোদনের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার হাতে পায় বাংলাদেশ। ঋণের শর্ত হিসেবে বেশ কিছু আর্থিক ও নীতি সংস্কারে মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে।
এর মধ্যে ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ব্যাংক ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী করে প্রকাশ, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ইত্যাদি।
প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি দেখে পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের জন্য আইএমএফ এর আর্টিকেল-ফোর এর অধীনে রিভিউ মিশনের প্রতিনিধি দলটি ৩ অক্টোবর বাংলাদেশে আসে।
কমেন্ট