এলডিসি উত্তরণের পরও শুল্ক সুবিধা পাবে বাংলাদেশ

এলডিসি উত্তরণের পরও শুল্ক সুবিধা পাবে বাংলাদেশ

সোমবার এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোকে সহযোগিতার জন্য ডব্লিউটিওর সদস্যরা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন। ছবি: ডব্লিউটিওর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের পরও বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।

সোমবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। ডব্লিউটিও—এর ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে ডব্লিউটিওর নির্ধারিত ১৩তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য সোমবার সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে জেনারেল কাউন্সিল বা সাধারণ পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই এলডিসি উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোকে সহযোগিতা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২০২৬ সালের নভেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের কথা রয়েছে। এ অবস্থায় ডব্লিউটিওর নতুন সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের পরেও একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যদিও ডব্লিউটিও এই সম্প্রসারিত সুবিধা কত দিনের জন্য হবে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেনি।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে (এলডিসি) বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা দেয় আন্তর্জাতিক বিশ্ব। যেমন এলডিসিভুক্ত দেশগুলো উন্নত বিশ্বে শুল্ক ও কোটার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বাজার–সুবিধা পায়। আবার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মগুলো প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও তারা কিছুটা ছাড় পায়।

কোনো দেশ জাতিসংঘের কিছু নির্দিষ্ট উন্নয়নের মানদণ্ড পূরণ করলে সেই দেশকে আর এলডিসি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। তখন নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি উত্তরণ হওয়া দেশগুলো বিশেষ সুবিধাও পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ এলডিসি উত্তরণের পথে রয়েছে, তাদের জন্য বিদ্যমান কিছু সুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হলো।

বিদ্যমান নিয়ম অনুসারে, ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে বাংলাদেশের শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার–সুবিধা হারানোর কথা ছিল। এখন নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী ধাপে কিছু সময়ের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়ালা।

'স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নয়ন অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন' হিসেবে উল্লেখ করে ডব্লিউটিওর তিনি বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে এ সিদ্ধান্ত। ডব্লিউটিওর সদস্যরা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে মসৃণ করতে এগিয়ে এসেছে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অগ্রগতির কোনো ক্ষতি ছাড়াই এসব দেশ এলডিসি উত্তরণের দিকে যেতে পারবে।”

“ডব্লিউটিও'র সদস্যরা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতির যে কোনো ক্ষতি রোধ ও এই প্রক্রিয়াকে মসৃণ করতে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।”

ডব্লিউটিও'র মহাপরিচালক বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশগুলো যেসব চ্যালেঞ্জে পড়ে সেগুলো মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এটি এসব দেশের জনগণকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে সহায়তা করবে।”

ডব্লিউটিওতে এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়কারী ও জিবুতির রাষ্ট্রদূত কাদরা আহমেদ হাসান বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ হওয়া ডব্লিউটিওর এলডিসি গ্রুপের জন্য একটি প্রধান অগ্রাধিকার। এ সিদ্ধান্তটি এসব দেশের বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থায় আরও একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।”

বিশ্বে বর্তমানে ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬টি দেশ এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ডব্লিউটিওর সদস্য দেশ ১০টি। এগুলো হলো বাংলাদেশ, অ্যাঙ্গোলা, কম্বোডিয়া, জিবুতি, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল, সেনেগাল, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও জাম্বিয়া।

বাকি দেশগুলোর মধ্যে চারটি ডব্লিউটিওতে নিজেদের প্রবেশের শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করছে। এগুলো হলো ভুটান, কমোরোস, সাও টোমে অ্যান্ড প্রিন্সেপ ও পূর্ব তিমুর। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণের পথে থাকা অন্য দুটি দেশ হলো কিরিবাতি ও টুভালু।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ এবং ডব্লিউটিও'র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে দুই বছরের করোনা মহামারি এবং পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে উত্তরণের পর আরও ছয় বছর বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে ৪৮ স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাণিজ্য সুবিধা ব্যবহার করে শুল্ক সুবিধার শীর্ষে আছে।

বাংলাদেশের রপ্তানির ৭৩ শতাংশেরও বেশি অংশ বাণিজ্য সুবিধার আওতায় আছে।

২০১৭ সালে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ঘোষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উত্তরণ পর্যায়ে যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তাতে সহায়তা করার জন্য ডব্লিউটিও সদস্যদের অনুরোধ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এলডিসি গ্রুপ ২০২০ সালে ডব্লিউটিওকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়।

এই সিদ্ধান্তের খসড়া প্রণয়ন, জমা দেওয়া ও চূড়ান্ত করার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এলডিসি ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে ট্র্যাকশন ও বহুপাক্ষিক সমঝোতা সৃষ্টির জটিল ও বিস্তৃত প্রক্রিয়ায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।

স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণের পর ডব্লিউটিও'র বিদ্যমান এলডিসি-নির্দিষ্ট বিশেষ বিধানগুলো সম্প্রসারণের জন্য বর্তমানে এলডিসি সাব-কমিটিতে আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সদস্যরা ১৩তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।

২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট ওই সুপারিশ করে। তাতে বলঅ হয়, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে।

এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের কিছু বাণিজ্য ও অন্যান্য সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। কিছু সুবিধাও মিলবে। কিন্তু অর্জন করতে হবে।

এবার দেখা যাক এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশ কী ধরনের সুবিধা পেতে পারে কিংবা কী ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে।

এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পায়। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।

এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। ডব্লিউটিওর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বাড়তি শুল্কের কারণে রপ্তানি বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা কমতে পারে।

বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না।

এর কারণ, মেধাস্বত্বের (পেটেন্ট) ওপর অর্থ দেওয়া হলে ওই ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্পমূল্যে ওষুধ পাবে না। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা বেশি পেয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধশিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।

২০৩৩ সালের আগে যদি কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধ শিল্পের এই সুবিধা থাকবে না। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এই সুবিধা শেষ হয়ে যাবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি বলে ধরে নেওয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশও এ ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে।

এ ছাড়া এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে। এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশসহ এলডিসিভুক্ত দেশের জন্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা আরও কয়েক বছর অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ।

গত বছরের ২২ জুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদর দপ্তরে সংস্থার ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনেও এই দাবি জানান। ডব্লিউটিও আয়োজিত ১৬৪ দেশের ওই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

 

ভোটের আগে এডিপি বাস্তবায়নে বেহাল দশা পরবর্তী

ভোটের আগে এডিপি বাস্তবায়নে বেহাল দশা

কমেন্ট