হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়াবে
দুই বছরের করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই সংকটে আছে দেশের অর্থনীতি। ফের হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়াবে।
হরতালের পর নতুন কর্মসূচি হিসেবে তিন দিনের অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি; আগামী মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশজুড়ে 'সর্বাত্মক অবরোধ' পালন করবে সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনে থাকা দলটি।
হরতাল-অবরোধ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল দেশের মানুষ। বহুদিন পর হরতাল ডাকা হয় রোববার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ কাঁপাচ্ছে সরকারি ও বিরোধী দল। ফের জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে দেশে।
২৮ অক্টোবর ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনার অনেক কিছুই শনিবার বাস্তব হতে দেখেছে দেশবাসী। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মত উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় আছেন গবেষক–অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা।
সবার এক কথা, দুই বছরের করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই সংকটে আছে দেশের অর্থনীতি। ফের হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়াবে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, চলমান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকটের সাথে অভ্যন্তরীণ সংকট যুক্ত হলে শিল্পোৎপাদন, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডসহ সামগ্রিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ ব্যাহত হলে বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ার পাশাপাশি শিল্পোৎপাদনও ব্যাহত হবে। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে যেসব পণ্য সরবরাহ হয়, সেটিও বাধাগ্রস্ত হবে। সংকট ঘনীভূত হলে বৈশ্বিক ক্রেতারাও বিকল্প উৎস খুঁজবেন।
ডলার–সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের নিম্নমুখী অবস্থা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ। এখন নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কী হবে—এ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর কপালে।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বেশ ভালোই চলছিল। বেশ কিছুদিন হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ছিল না। আবার শুরু হয়েছে অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এ সব ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী। আর এতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। বর্তমানে অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি করা যাচ্ছে না। কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা পুরোপুরি উৎপাদন করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে সংঘাতের রাজনীতি অর্থনীতিতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচি নেওয়ার আহ্বান জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির(এমসিসিআই) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, যার যার জায়গা থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার ফলে করোনা মহামারীকে বাংলাদেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতিসহ নানান চ্যালেঞ্জ এসেছে অর্থনীতিতে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির ফলে অস্থিরতা দেখা দিলে অর্থনীতিতে তা আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে দেশের অবকাঠামোখাতে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। সবাই ভাবছেন, বাংলাদেশ আগামীতে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হবে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন একটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য। এরকম সময়ে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা কাম্য নয়।”
"সাধারণ মানুষের ভালো থাকার জন্য, তৃতীয় শক্তির অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা দরকার। ব্যবসায়ীরা আশা করে, রাজনৈতিকগুলো তাদের কর্মসূচি পালনে এসব বিষয় বিবেচনা করবেন। সবাইকে মাথায় রাখতে হবে– বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে যাতে নেতিবাচক বার্তা না যায়," বলেন সায়ফুল।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, "বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কমছে। এরমধ্যে দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে রপ্তানিমুখী শিল্প খুবই সংকটে পড়বে। এরকম সময়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। অস্থিরতা হলে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবেন। অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে।"
তিনি বলেন, “অর্থনীতি এমনিতেই খারাপের দিকে রয়েছে। রিজার্ভের পতন ঠেকছে না। আছে ডলার–সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। ওই যুদ্ধের খারাপ ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। নতুন করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।”
তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে বলেও আশাবাদী ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, “হরতাল-অবরোধ আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন আবার দেখতে হচ্ছে। হরতাল-অবরোধ কিন্তু খুবই ক্ষতিকর। সংঘাতময় এ সব কর্মসূচীর কারণে অর্থনীতির সমূহ দুরবস্থা কী হতে পারে, তা ভেবে আমরা খুবই ভয় পাচ্ছি। জানি না, ব্যবসায়ীরা যাবেন কোথায়?”
“সবারই জানা আছে যে, অর্থনীতি খারাপ হলে সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। আমার আবেদন হচ্ছে, সংঘাত যাতে না হয়। সংঘাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান হোক।”
বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, "দেশের বস্ত্র খাতসহ অন্যান্য শিল্প গভীর সংকটে আছে। প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম সময়ে কোনো ধরনের অচলাবস্থা দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি মারা যাবে।"
“ব্যবসায়ীরা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন চান। রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি নেবে, সেটাতে ব্যবসায়ীদের সমর্থন রয়েছে। তবে কোনো ধরনের অস্থিরতা, সহিংসতা হলে সেটা সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে," যোগ করেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "এটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা; বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের। নির্বাচন এলেই এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যার খেসারত দিতে হয় পুরো দেশকে। এবারও সংঘাত দেখা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে– এই সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।"
“সংঘাত চরম আকার নিলে তার অর্থনৈতিক প্রভাব হবে ব্যাপক। কারণ এবার অন্যান্য সময়ের তুলনায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ দুর্বল, বৈশ্বিক অবস্থাও পক্ষে নেই," বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, "যেকোনোভাবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই হতে হবে। নতুবা রাজনৈতিক দল, দেশ সবাই হারবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি আর সাধারণ মানুষ।"
“চিন্তার বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জন করতে পারলাম না। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করা, একটি ভালো নির্বাচন করা—এসব করতে পারলাম না আমরা।”
“ফলে প্রতিবারই মেয়াদের শেষ সময়ে একই ধরনের ঝামেলা হয়। এখন রাজনীতিতে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে অর্থনীতি ভুগবে। সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষও ভুগবে।”
আহসান মনসুর বলেন, “অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনীতি ঠিক না থাকলে কিছুই ঠিক থাকবে না। নিরাপত্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে যাচ্ছে। যখন নিরাপত্তা থাকবে না, তখন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন না।”
“তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় চাপে থাকা অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়বে।”
কমেন্ট