সরকার যে বেতনকাঠামো দেবে, মালিকরা তা মেনে নেবেন: ফারুক হাসান
সোমবার গাজীপুরের চান্দনার ভোগড়া এলাকায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা সড়ক অবরোধ করে একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। ছবি: সংগৃহীত
সরকার তৈরি পোশাক খাতের জন্য নতুন যে বেতনকাঠামো ঘোষণা করবে, পোশাকশিল্পের সব উদ্যোক্তা তা মেনে নেবে বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাকমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেছেন, “যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন, পোশাকমালিকেরা নতুন মজুরি কাঠামো মেনে নিয়ে আগামী ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর করবে।”
মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরার বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন বিজিএমইএ প্রধান।
সম্প্রতি পোশাকশিল্প খাতে শ্রমিক হতাহত হওয়ার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন ফারুক হাসান। তিনি নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং যেসব মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের প্রতি সমবেদনা জানান।
কয়েক দিন ধরে বহিরাগত ব্যক্তিদের উসকানিতে কিছু পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন এবং কারখানা ভাঙচুর করছেন বলে অভিযোগ করেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, এতে অনেক উদ্যোক্তা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এটাকে তিনি অনভিপ্রেত হিসেবে আখ্যা দেন। তবে এর চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, বহিরাগত ব্যক্তিদের উসকানির কারণে পোশাক কারখানার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু লেদার কারখানা, রাসায়নিক গোডাউন, ফেব্রিকসের গোডাউন, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের উদ্দেশে ফারুক হাসান বলেন, “আপনাদের অবদানেই শিল্প বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এমন কিছু করবেন না, যাতে শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ক্রেতাদের আস্থা বিনষ্ট হয়। এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
“ক্রেতারা শিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আপনারা কর্মহীন হয়ে পড়বেন, যা কাম্য নয়।”
দুঃখ প্রকাশ করে ফারুক হাসান বলেন, “মালিকেরা যখন শিল্প ও অর্থনীতি সচল রাখতে ও পোশাককর্মীদের কর্মসংস্থানের খাত সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে ধৈর্য সহকারে কারখানা চালু রেখেছেন ও রাখছেন, তখন কোনাবাড়ি এলাকায় বিজিএমইএর সদস্য প্রতিষ্ঠান এবিএম ফ্যাশন লিমিটেডে অগ্নিসংযোগের ঘটনা মালিকদের হতোদ্যম করেছে।”
সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতের রপ্তানির বর্তমান চিত্র তুলে ধরেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, চলতি ২০২৩ (পঞ্জিকা বর্ষ) সালের প্রথম আট মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক পোশাক আমদানি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এ সময় মূল্যের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক পোশাক আমদানি কমেছে ২২ দশমিক ২৭ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তাদের আমদানি কমেছে প্রায় ২১ দশমিক ৭৭।
অন্যদিকে পরিমাণের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আমদানি ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে কমেছে ২৯ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ পরিমাণের দিক থেকে এই আট মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
একই সময় ইউরোপের বৈশ্বিক আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং বাংলাদেশ থেকে কমেছে ১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। পাশাপাশি পরিমাণের দিক থেকে সারা বিশ্ব থেকে আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ থেকে কমেছে ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশ।
কারখানা বন্ধ করার হুমকি
সংবাদ সম্মেলনে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে কোথাও সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দিলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, “নভেম্বরের মধ্যে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হবে। ডিসেম্বর থেকে তা বাস্তবায়ন করবো। সহিংসতা হলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গত এক সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিক বিক্ষোভ করে আসছেন গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। এর মধ্যেই ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণের ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি গড়ায় সহিংসতায়।
সোমবার গাজীপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধলে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। বিক্ষোভ চলাকালে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন দেওয়া হয়; সেখানে প্রাণ যায় আরেকজনের।
মঙ্গলবার দুপুরে বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ যখন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করছিলেন, তখনও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন শ্রমিকরা।
তাদের অবরোধের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কালিয়াকৈরের মৌচাক বাজার এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় শ্রমিকরা।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত নির্ধারণ করা হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, “গুজবে কান দেবেন না। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকার বেশি নির্ধারণ করা হবে।”
শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানান, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ বছরের জন্য নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয় সর্বনিম্ন ৮ হাজার টাকা। আগামী ৩০ নভেম্বর এর মেয়াদ শেষ হবে।
“মালিকপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা। আর শ্রমিকপক্ষ প্রস্তাব দিয়েছে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা। শ্রমিকদের মধ্যে কে বা কারা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ হয়ে গেছে। তারা এই বিভ্রান্তিতে ভুগছেন।
“মজুরি নির্ধারণের জন্য এখনও এক মাস বাকি আছে। ১ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভা আছে। কারও কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে কাজে ফিরে ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা বিধান করবেন- আমি শ্রমকিদের প্রতি এই আহ্বান জানাই। কারও ফাঁদে যেন তারা পা না দেন।”
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বর্তমান কমিটির সহসভাপতি শহিদ উল্লাহ আজিম এবং এস এম মান্নান কচিসহ পোশাক খাতের মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।
কমেন্ট