রেমিটেন্সে ফের উল্লম্ফন, অক্টোবরে এলো প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ফের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে বড় ধসের পর অক্টোবর মাসও শুরু হয়েছিল সেই পতনের ধারায়। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার রেমিটেন্স প্রবাহের অক্টোবর মাসের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি। আগের মাস সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ।
গত সেপ্টেম্বরে ১৩৩ দশমিক ৪৪ কোটি (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসাবে যা ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০২২ সালের অক্টোবরে এসেছিল ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় লকডাউন; সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।
কমতে শুরু করে রেমিটেন্স। সেই ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিটেন্স ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিলে তা আরও কমে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে নেমে আসে।
এর পর থেকে অবশ্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবরে বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৭৫ কোটি ৮৮ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার।
এর বাইরে ৯ বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার রেমিটেন্স দেশে এনেছে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়।
২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাবেন।
এদিকে ডলারের দর আরও ৫০ পয়সা বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। বুধবার থেকে রেমিটেন্স ও রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে প্রতি ডলার ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১১১ টাকায় বিক্রি করবে ব্যাংকগুলো।
মঙ্গলবার বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন জানিয়েছেন।
এত দিন ১১০ টাকায় ডলার কিনে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রির সিদ্ধান্ত ছিল।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬০ কোটি (১.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
তার পরও রিজার্ভ কমছে
রেমিটেন্সে বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে না; উল্টো কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। হিসাব বলছে, সেই বিল যদি ১ বিলিয়ন ডলারও হয়, তাহলেও রিজার্ভ আরও কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারের নিচে—২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ‘গ্রস’হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।
তার আগে রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
কয়েক দিনের মধ্যে আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে আসবে বলে হিসাব দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রণোদনা বাড়িয়ে রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা বেশি দিন ধরে রাখা রাখা যাবে না। সত্যিকার অর্থে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বাড়াতে হলে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে।”
কমেন্ট