অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির পারদ ৯.৯৩ শতাংশে উঠেছে
৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ ফের চড়েছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। যা ছিল এক যুগ বা ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
সেপ্টেম্বরে অবশ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিম্মমূখী হয়। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নামে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশে।
অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে—৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
অক্টোবর মাসে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
আর ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের অক্টোবরে মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের অক্টোবরে তা কিনতে ১১২ টাকা ৯৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, কয়েক মাস টানা বেড়ে গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠে।
জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে আসে। জুলাই মাসে আরও কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে আসে।
আগস্ট মাসে তা আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে উঠে যায়। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমে এসেছিল।
গড় মূল্যস্ফীতি ৯.২৯ শতাংশ
১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ।
তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
৬ শতাংশে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ
বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেশ দ্রুত গতিতে কমলেও বাংলাদেশে কমার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন কি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
শ্রীলংকার শুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছিল ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৪৩ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়ায়। গত মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। এপ্রিলে এটি আরো কমে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৮ শতাংশে। এর পরের মে মাসে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জুনে মূল্যস্ফীতি এক অংকে নেমে আসে, যা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। আগস্টে এই সূচক আরও কমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।
গত সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। সর্বশেষ অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশে।
বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়স সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকে।
গ্রামে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ
অক্টোবরে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে উঠেছে। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৮%
অক্টোবরে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।
যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় গত অর্থবছরের পুরো সময় জুড়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এ রকম এক সময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম।
ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবরে তা আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে।
নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে।
তবে রোজার মাসকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। মে মাসে মূল্যস্ফীতির পারদ বেড়ে এক লাফে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে গিয়ে উঠেছিল।
মজুরি সূচক ৭.৬৯ শতাংশ
বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। গত বছরের অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
জানুয়ারিতে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
মার্চ মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।
মে মাসে মজুরি সূচক বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। জুন মাসে তা আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশে উঠে।
জুলাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক বেড়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে। আগস্ট মাসে তা আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ হয়। উঠে।
সেপ্টেম্বর মাসে আরও খানিকটা বেড়ে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশে উঠে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
কমেন্ট