সর্বজনীন পেনশনে সাড়া নেই
প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে এ কর্মসূচিতে যোগ দেন মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন। তৃতীয় মাসে তা আরও ভাটা পড়ে; ১ হাজার ১৩৪ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
‘সুখে ভরবে আগামী দিন, পেনশন এখন সর্বজনীন’ এ স্লোগানকে ধারণ করে প্রৌঢ় জীবনকে সুখে ভরাতে সরকারের নতুন কর্মসূচিতে তেমন সাড়া মিলছে না।
বহুল প্রতীক্ষিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিম চালুর তিন মাস পূর্ণ হয়েছে শুক্রবার। প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চার স্কিমে প্রথম মাসে প্রায় ১৩ হাজার জন অন্তর্ভুক্ত হলেও দ্বিতীয় মাসে এ কর্মসূচিতে যোগ দেন মাত্র ১ হাজার ৬৬৯ জন। তৃতীয় মাসে তা আরও ভাটা পড়ে; ১ হাজার ১৩৪ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে তিন মাসে এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৫৪ জন। সরকার আশা করেছিল সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি বা স্কিমে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।
না হওয়ায় এ কর্মসূচিতে জনগণের আগ্রহ কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে শনিবার দুপুরে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, পেনশন স্কিমে যোগ দিতে সবচেয়ে কম চাঁদা জমা পড়েছে শেষের এক মাসে। শেষের এক মাস ধরা হয়েছে ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বরের দুপুর ১২টা পর্যন্ত।
তবে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ অবশ্য আশাবাদী যে খুব শিগগির গ্রাহকদের ভালো সাড়া মিলবে। কারণ, সরকার এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে গ্রাহকদের থেকে চাঁদা জমা পড়েছে মোট ১৬ কোটি ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।
গত ১৭ আগস্ট এ স্কিম উদ্বোধনের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম এক মাসে চাঁদা পরিশোধ করেছিলেন ১২ হাজার ৮৮৯ জন। পরের এক মাসে নতুন করে ১ হাজার ৮৩১ জন যুক্ত হওয়ায় মোট চাঁদাদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ হাজার ৭২০। তার পরের মাস, অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত পেনশন স্কিমে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন আরও ১ হাজার ১৩৪ জন। এ তিন মাস মিলিয়েই মোট চাঁদাদাতা হয়েছেন ১৫ হাজার ৮৫৪ জন।
তবে চাঁদাদাতাদের পরিসংখ্যান বলছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যোগদানের সংখ্যা প্রতি মাসেই কমছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের দিন থেকেই তা সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। প্রথম দিন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ৮ হাজার মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করলেও পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে চাঁদা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৭০০ জন।
চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন স্কিম রয়েছে। এগুলোর নাম হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাস। বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস’এবং দেশের নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’।
পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চার স্কিমের মধ্যে প্রগতিতে ৭ হাজার ২১ জন ৮ কোটি ৬০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, সুরক্ষায় ৬ হাজার ৫২৮ জন ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা, প্রবাসে ৪৭৪ জন ১ কোটি ৪১ লাখ ৪১ হাজার টাকা এবং সমতায় ১ হাজার ৮২২ জন ৪৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা চাঁদা জমা দিয়েছেন।
আশাবাদী কর্তৃপক্ষ
চাঁদা দিয়ে পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারেন ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ। দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষ পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় আসবেন—এমন প্রত্যাশা সরকারের রয়েছে। বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনা এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই পেনশন স্কিম চালু করা হয়।
দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন—সরকারের এমন প্রত্যাশা থাকলেও প্রথম তিন মাস পর্যন্ত মানুষের সাড়া খুবই কম। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা আশা করছেন, মানুষ এই কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা শনিবার এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ “দেশ ও দেশের বাইরে সর্বজনীন পেনশন স্কিম আরও জনপ্রিয় করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।”
তিনি বলেন, “শুরুতে সোনালী ব্যাংক থাকলেও এখন অগ্রণী ব্যাংকও পেনশন স্কিমের সেবা দেওয়ার কাজ করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গেও এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। ফলে স্কিম নিয়ে আমরা খুবই আশাবাদী।”
আশাবাদের আরও কোনো ভিত্তি আছে কি না, তা জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, “প্রবাস স্কিমের কথা যদি বলি, অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন কিন্তু অর্থ পাঠাতে পারছেন না। কারণ, অনেকেরই ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড নেই। এ সমস্যা দূর করতে এখন যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) আসে, সেসব ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার কাজ চলছে। অর্থসচিব সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি বৈঠক করেছেন।”
প্রগতি স্কিমের আওতায় একটা প্রতিষ্ঠানও যদি এসে যায়, তাহলেই তো ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাহক যুক্ত হয়ে যাবেন—এমন মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, “একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে আরও প্রতিষ্ঠান আসবে।”
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের সব মানুষকে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে সরকারের সর্বজনীন এই কর্মসূচি চালু করে সরকার।
চার শ্রেণির নাগরিককে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এই কর্মসূচি।
পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন একজন চাঁদাদাতা। তবে চাঁদাদাতা মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন চাঁদাদাতার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত।
অর্থাৎ কোনো চাঁদাদাতা যদি ৬০ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে তার ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ বছর তার নমিনি পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, পেনশন স্কিমের মত এত বড় কর্মযজ্ঞ চালু করার আগে অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কারা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, তার ওপর কোনো জরিপও হয়নি। এমনকি উদ্বোধনের পরও খুব একটা প্রচার নেই।
একই সঙ্গে এ কর্মসূচি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে দেওয়া হয় না। সার্বিকভাবে পরিষ্কর ধারণা জনগণকে দেওয়া না হলে এ উদ্যোগ সফলতা পাবে না।
তিনি বলেন, “আগামী নির্বাচন সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে মানুষের আগ্রহের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এ কার্যক্রম যেহেতু আইন দ্বারা সুরক্ষিত, তাই টাকা খোয়া যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। স্কিম কোনো কারণে বন্ধ হলে সুদসহ অর্থ ফেরত পাবে জনগণ। তার পরও মানুষের মনে সন্দেহ হতেই পারে।”
কমেন্ট