বিদেশি ঋণের ৬৮% চলে গেছে সুদ-আসল শোধে
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের মোট ঋণ-সহায়তার মধ্যে ১১০ কোটি ১৫ লাখ ডলার চলে গেছে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে যে বিদেশি ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে, তার ৬৮ শতাংশই চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) মঙ্গলবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকুলে ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে।
এর মধ্যে ১৫৬ কোটি (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ৬ কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার অনুদান। অনুদানের মধ্যে ৫ কোটি ৯৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার প্রকল্প সহায়তা। আর ৫৫ লাখ ডলার খাদ্য সহায়তা।
ইআরডি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের মোট ঋণ-সহায়তার মধ্যে ১১০ কোটি ১৫ লাখ ডলার চলে গেছে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৬৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই চার মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা মোট ১৯৭ কোটি (১.৯৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছিল। যার মধ্যে ৭২ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার ডলার চলে যায় আগের ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। আসল পরিশোধ করা হয়েছিল ৫৩ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল ১৮ কোটি ৭৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিদেশি ঋণ-সহায়তা কমেছে ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েছে ৫২ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে আর সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৪৯ শতাংশ বা আড়াই গুণ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৯ গুণ
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমেছেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমতে কমতে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু কম সুদের এই ঋণ কমছে। তবে, আশার কথা হচ্ছে—আগামীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাড়িয়েছে দাতারা।
ইআরডির তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ১০ হাজার (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল ৪১ কোটি ৩৮ লাখ ১০ হাজার ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দাতাদের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৭৭৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা প্রায় ৯ গুণ।
সবচেয়ে বেশি দিয়েছে জাপান
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ৫১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার দিয়েছে। এই অঙ্ক মোট ঋণ-সহায়তার ৩২ শতাংশ।
অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক ৩৩ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২৯ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, রাশিয়া ২৬ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার, চীন ৩ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ছাড় করেছে।
ভারত দিয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের (এআইআইবি) ছাড় করেছে ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটির কাছ থেকে এই চার মাসে প্রতিশ্রুতি এসেছে ১৫০ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার (১.৫০ বিলিয়ন) ডলার।
এ ছাড়া এডিবির কাছ থেকে ১০৩ কোটি ৩৮ লাখ (১.০৩ বিলিয়ন) ডলার, বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ৩০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
বিদেশি ঋণ খুব প্রয়োজন এখন
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সবশেষ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। এই মাসে রেমিটেন্স খানিকটা বাড়লেও অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে কমেছে সাড়ে ৪ শতাংশের মতো। এটা একটা উদ্বেগের বিষয়।”
“বিদেশি ঋণ-সহায়তা তেমন আসছে না। রপ্তানি আয় কমছে। এতে রিজার্ভ কমছেই। অর্থনীতিতে সংকট বাড়ছে। সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
“যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”
সংকট কাটাতে কম সুদের বিদেশি ঋণ এখন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।
কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
কমেন্ট