রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে

২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। চার মাস ২১ দিন পর মঙ্গলবার বিবিএস ওই অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেছে।

পৌনে দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে—তার একটি চিত্র পাওয়া গেছে গত অর্থবছরের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চূড়ান্ত হিসাবে।

মঙ্গলবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস।

তাতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে তা কমে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসে।

তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) তা আও কমে ২ দশমিক শূন্য চার শতাংশে নেমে আসে। শেষ প্রান্তিক অর্থাৎ গত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে ওঠে।

২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। চার মাস ২১ দিন পর মঙ্গলবার বিবিএস ওই অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেছে।

এর আগে ১৬ মে ওই অর্থবছরের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছিল পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে ছয় মাসের (২০২২ সালে জুলাই থেকে ডিসেম্বর) অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক হিসাব করে বলা হয়, দেশে ওই সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।

তখন ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে (তিন মাস পর পর) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত না বিবিএস।

প্রথা অনুযায়ী আগে ছয় মাস বা নয় মাসের তথ্য হিসাব করে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই জিডিপির সাময়িক বা প্রাথমিক হিসাব প্রকাশ করা হতো। পরে অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করত পরিসংখ্যান ব্যুরো।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশ করছে।

সে সময় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। মঙ্গলবার তার সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার প্রান্তিকের জিডিপির তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। একসময় তা ৭ শতাংশ পেরিয়ে ৮ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বার্ষিকভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি কখনোই নেতিবাচক হয়নি।

কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, করোনা মহামারীর শুরুতে বড় ধাক্কা খেয়েছিল দেশের অর্থনীতি। ২০২০ সালে করোনার শুরুর সময়ে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রথমবারের মতো দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল। ওই প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় জিডিপির আকার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল; অর্থাৎ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম ‘লকডাউন’ দেওয়া হয়। সরকার কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। শুরুতে প্রায় দুই মাসের মতো ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি ছিল। তখন প্রায় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ অথবা স্থবির ছিল।

ওই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯–২০ সালে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করার কারণে কোভিডের প্রথম ধাক্কার ‘লকডাউনের’সময়টিতে অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হয়েছিল, তা জানা সম্ভব হয়েছে।

ঠিক দুই বছর পরে একই প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি আরেকবার সংকটের মুখোমুখি হয়। তখন থেকেই অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়া শুরু করে। ওই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি দুইয়ের ঘরে নেমে এসেছিল।

করোনার প্রথম তিন মাস

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসেই অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। ‘লকডাউনের’কারণে সে সময় যানবাহন চলেনি। মানুষ বাইরেই বেরিয়েছে খুব কম। দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রথম কিছুদিন প্রায় বন্ধই ছিল বলা চলে। অর্থনীতির গতি ছিল মন্থর।

বিবিএস বলছে, ওই তিন মাসে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কম।

এর মানে হলো, ওই প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে অর্থনীতি খারাপ চলেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন হয়েছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এই হিসাবগুলো স্থিরমূল্যে করা হয়েছে।

১২টি খাত নিয়ে জিডিপি হিসাব করা হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে ১০টি খাত সংকুচিত হয়েছিল। এগুলো হলো কৃষি, শিল্পকারখানা, খনিজ সম্পদ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নির্মাণ, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, পরিবহন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন।

প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছিল জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য এবং আবাসন খাত।

পরের দুই প্রান্তিকেও অবস্থার খুব উন্নতি ঘটেনি, তবে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেলে। পরের ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি অবশ্য ১ শতাংশের কম ছিল। বিবিএসের হিসাব বলছে, ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।

২০২১ সালের শুরু থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।

তবে বিবিএসের হিসাবে, অর্থনীতি দারুণভাবে চাঙা হয় ওই বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে। ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি এক লাফে ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশে উঠে যায়। বিবিএস যে আট অর্থবছরের (২০২১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর) ২৮টি প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি তুলে ধরেছে, তাতে দেখা গেছে যে ওই প্রান্তিকেই সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও উঠে এসেছে বিবিএসের হিসাবে। ২০২২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট শুরু হয়। বিঘ্নিত হয় পণ্য সরবরাহব্যবস্থা, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও।

২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে। অথচ আগের দুই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি।

২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উল্লম্ফন দেখা দেয়; ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ অর্জিত হয়।

দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে তা কমে ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসে।

তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) তা আরও কমে ২ দশমিক শূন্য চার শতাংশে নেমে আসে। শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) অবশ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে ওঠে।

এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পাঁচ মাস শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এখনও প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস।

বিদেশি ঋণের ৬৮% চলে গেছে সুদ-আসল শোধে পরবর্তী

বিদেশি ঋণের ৬৮% চলে গেছে সুদ-আসল শোধে

কমেন্ট