সরকারি গুদামে মজুত কমছে, বাড়ছে চালের দাম
সরকারি হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। মাঝারি ও সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) চালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ। এর আগে বেশি কিছুদিন বাজারে চালের দাম মোটামুটি একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল।
সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যের মজুত বেশ কমে এসেছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার সরকারের গুদামগুলোতে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪১১ হাজার মেট্টিক টন। অথচ চার মাস আগেও এই মজুত বাড়তে বাড়তে ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
আর মজুত কমায় চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। মাঝারি ও সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) চালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ। এর আগে বেশি কিছুদিন বাজারে চালের দাম মোটামুটি একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল।
সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই চাল আমদানি না হওয়ায় এবং ৩০ টাকা কেজি দরে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিক্রি, ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) ও ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ অব্যাহত থাকায় খাদ্যের মজুত কমছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান।
তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা বলেছেন, দেশে আমন ধান ওঠা শুরু হয়ে গেছে; ফলন বেশ ভালো হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়ে গেছে। এখন মজুত ফের বাড়বে। চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, শনিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকায়। আর সরু চাল (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭৫ টাকায়।
এক মাস আগে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। মাঝারি মানের চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা আর সরু চালের দাম ছিল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা।
এ হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে এই তিন ধরনের চালের দাম কমেছে যথাক্রমে ২, ৩ ও ৪ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সব মিলিয়ে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪১১ মেট্টিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৪৬ টন, গম ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬২২ টন এবং ধান ৩১৩ টন।
অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে ২০ লাখ ১০ হাজার টনে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত গত বছরের মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে। এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়।
এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত; আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মজুত ১৯ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এর পর বেরো মৌসুম শুরু হয়; বোরোর বাম্পার ফলনে আমদানি ছাড়াই গত ১২ আগস্ট মজুত সাড়ে ২০ লাখ টনে গিয়ে পৌঁছে।
৫ মাসে কোনো চাল আমদানি হয়নি
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (১ জুলাই থেকে ২৩ নভেম্বর) সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই কোনো চাল আমদানি হয়নি। তবে ১৮ লাখ ৬ হাজার ৪৩০ টন গম আমদানি হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬০ টন চাল ও ৩৮ হাজার ৭৫ হাজার ১০০ গম আমদানি হয়।
চালের দাম বাড়ালে কাউকে ছাড় নয়
চালের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
তিনি বলেছেন, “ইতোমধ্যে ৬০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। নতুন ধান বাজারে উঠতে শুরু করেছে। ধানের দামও এখন কম। এ অবস্থায় চালের দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই।”
“চলতি মৌসুমে আমনের ফলনও ভালো হয়েছে। দেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য মজুদ আছে। চালের বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে প্রসাশন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। অজুহাত দিয়ে চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না।”
বৃহস্পতিবার চলতি মৌসুমের আমন ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে এ কথা বলেন খাদ্যমন্ত্রী।
গত ৮ অক্টোবর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় চলতি বছরের আমন ধানের সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি কেজি আমন ধানের দাম ৩০ টাকা, প্রতি কেজি আমন সেদ্ধ চাল ৪৪ টাকা এবং আমন আতপ চালের দাম ৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এবারের আমন মৌসুমে ২ লাখ টন আমন ধান, ৪ লাখ টন সেদ্ধ চাল এবং ১ লাখ টন আতপ চাল কেনা হবে। সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের এই কার্যক্রম চলবে ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মোতাবেক ধান-চাল সংগ্রহের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কৃষক যেন গুদামে ধান নিয়ে এসে হয়রানির শিকার না হয়, সেটা খাদ্য কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করতে হবে। ফুডগ্রেইন লাইসেন্স ছাড়া কেউ যেন ধান চালের অবৈধ ব্যবসা করতে না পারে, সেদিকে প্রসাশনের নজরদারি বাড়াতে হবে।”
সেইসঙ্গে মজুদ ও বিক্রির পাক্ষিক প্রতিবেদন দেওয়ারও নির্দেশনা দেন মন্ত্রী।
১৩ লাখ টন মুজত থাকলেই যথেষ্ট
খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই আমন ও বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার পর নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে সরকারের গুদামে খাদ্যের মজুত বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সন্তোষজনক মজুত থাকে।
এরপর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে চাল-আটা বিতরণ ও বিক্রির কারণে এই মজুত কমতে থাকে। মজুত বেশি কমে গেলে সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে মজুত গড়ে তোলে। গত কয়েক মৌসুম বোরো ও আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খাদ্য নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি সরকারকে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য সরকারের মজুত ১২ থেকে ১৩ লাখ টন থাকলেই যথেষ্ট। সে হিসাবে এখনো সন্তোষজনক মজুত আছে। তবে গত কয়েক বছর স্বস্তিদায়ক মজুত থাকলেও বাজারে চালের দাম কমেনি; উল্টো চলেছে।
অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে চালের দাম কমছে না- খোদ সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু চালের দাম লাগামের মধ্যে আসেনি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, “বর্তমানে মজুতের পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পগুলোর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের জন্য ভালো অবস্থায় আছে।”
আমনের উৎপাদন ভালোই হয়েছে জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “সরকার সংগ্রহ অভিযান ঠিকমতো পরিচালনা করলে মজুত ফের বাড়বে। ভালো দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। আমি অনুরোধ করব সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে যেন ধান কেনা হয়। তাহলে তারা পরবর্তীতে ধান উৎপাদনে উৎসাহী হবেন।”
কমেন্ট