বিদেশি ঋণ: প্রতিশ্রুতি বাড়ছে, কমেছে ছাড়
হিসাব বলছে, মোট ঋণ-সহায়তার ৬৩ শতাংশই চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ৭৭ কোটি ডলার। আর সুদ ৫৬ কোটি ২২ লাখ ডলার।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ২১১ কোটি ৭০ লাখ (২.১২ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৩৩ কোটি ২২ লাখ (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলারই চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
হিসাব বলছে, মোট ঋণ-সহায়তার ৬৩ শতাংশই চলে গেছে আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ৭৭ কোটি ডলার। আর সুদ ৫৬ কোটি ২২ লাখ ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ পরিশোধে প্রায় আড়াই গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৃহস্পতিবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকুলে ২১১ কোটি ৭০ লাখ (২.১২ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছে।
এর মধ্যে ২০৪ কোটি (২.০৫ বিলিয়ন) ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার অনুদান। অনুদানের মধ্যে ৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার প্রকল্প সহায়তা। আর ৫৫ লাখ ডলার খাদ্য সহায়তা।
ইআরডি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের মোট ঋণ-সহায়তার মধ্যে ১৩৩ কোটি ২২ লাখ ডলার চলে গেছে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭ কোটি ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৬ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা মোট ২৪৬ কোটি ২৫ লাখ (২.৪৬বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা ছাড় করেছিল। যার মধ্যে ৮৮ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার চলে যায় আগের ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। আসল পরিশোধ করা হয়েছিল ৬৪ কোটি ২৮ লাখ ডলার। আর সুদ পরিশোধ করা হয়েছিল ২৩ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণ-সহায়তা কমেছে ১৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। তবে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ১৩ গুণ
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৫৮৫ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার (৫.৮৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল মাত্র ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ১০ হাজার ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দাতাদের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ১১৭০ দশমিক ১১ শতাংশ বা প্রায় ১৩ গুণ।
সবচেয়ে বেশি দিয়েছে জাপান
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ৬১ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার দিয়েছে। এই অঙ্ক মোট ঋণ-সহায়তার ২৯ শতাংশ।
অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে রাশিয়া ৪৪ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংক ৩৮ কোটি ৭৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৪৪ কোটি ৪২ লাখ ৭০ হাজার ডলার, চীন ৩ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ছাড় করেছে।
এছাড়া ভারত দিয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের (এআইআইবি) ছাড় করেছে ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
জুলাই-নভেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটির কাছ থেকে এই পাঁচ মাসে প্রতিশ্রুতি এসেছে ১৫০ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার (১.৫০ বিলিয়ন) ডলার।
এ ছাড়া এডিবির কাছ থেকে ২০৬ কোটি (২.০৬ বিলিয়ন) ডলার, বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ (১.৪২ বিলিয়ন) ডলার প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
সংকট কাটাতে আরও ঋণ প্রয়োজন
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে।
এই চাপ সামাল দিতে বিদেশি আরও বেশি বিদেশি ঋণ-সহায়তার প্রয়োজন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের বহুল প্রতিক্ষিত দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, এডিবির ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে। আর এ কারণে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেশ খানিকটা বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ২১ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ৭৭ কোটি ডলার। আর ‘গ্রস’হিসাবে বেড়েছে ৭৮ কোটি ডলার।
আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়ার ঋণ যোগ হওয়ার আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “স্বস্তির খবর এই যে, আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়ার ঋণ পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। নির্বাচনের আগে হয়ত রিজার্ভ আর কমবে না। তবে নির্বাচনের দু-একদিন পরই কিন্তু আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) নভেম্বর-ডিসেম্বর ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন কিন্তু রিজার্ভ সেই আগের অবস্থায় নেমে আসবে।”
“সে কারণে রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতাদের কাছ থেকে আরও ঋণ-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
“যেসব ঋণ পাইপলাইনে আটকে আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করাতে দাতাদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে হবে।”
সংকট কাটাতে কম সুদের আরও বিদেশি ঋণ এখন খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দুই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল।
কিন্তু সেই জোয়ার আর থাকেনি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। সেই নেতিবাচক ধারা নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছর শুরু হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
কমেন্ট