৬ মাসে এডিপির ২২.৪৮% বাস্তবায়ন, ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
আইএমইডি মঙ্গলবার এডিপি বাস্তবায়নের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়,২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপি বরাদ্দ থেকে ৬১ হাজার ৭৩৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার একটার পর একটা উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করলেও চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে মন্থরগতি দেখা দিয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) মঙ্গলবার এডিপি বাস্তবায়নের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়,২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপি বরাদ্দ থেকে ৬১ হাজার ৭৩৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। যা মোট এডিপির ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
গত ২০২২–২৩ অর্থবছরের এই ছয় মাসে খরচ হয়েছিল ৬০ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।
প্রতি বছরই সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ে। সেই অনুযায়ী খরচও বাড়ে।
সেই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ২ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শতকরা হিসাবে এবার এডিপি বাস্তবায়নের হার গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে মোট এডিপির মাত্র ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
আগের ১৩ অর্থবছরের কোনোবারই অর্থবছরের প্রথম প্রথম ছয় মাসে এডিপি ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশের কম বাস্তবায়ন হয়নি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও এই হার ছিল ২৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এই ছয় মাসে খরচ হওয়া টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎসের ৩৪ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা, বিদেশি ঋণের (প্রকল্প সাহায্য) ২৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিলের ২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা হলো ১ হাজার ৩৯২টি।
সবশেষ ডিসেম্বর মাসে মোট এডিপির ১৪ হাজার ৮৮২ কোটি ৩১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শতাংশ হিসাবে যা ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যয় হয়েছিল ১৩ হাজার ১২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। শতাংশ হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এডিপি বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মূলত নির্বাচনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেছেন, নির্বাচনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হয়েছে।
আইএমইডির ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর পর্যন্ত বছরের প্রথমার্ধের অগ্রগতির তথ্য দেওয়া হয়েছে। সে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধের সময়কালে এত কম বাস্তবায়ন আর দেখা যায়নি।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল, সেটি ছিল তখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম বাস্তবায়নের পরিসংখ্যান।
এবার সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হওয়ায় সরকার বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়েছে। আর সংকটে পড়েই এডিপিতে অর্থের জোগান দিতে পারছে না। সে কারণে এবার বাস্তবায়ন কম হচ্ছে।”
“এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এডিপি বাস্তবায়ন বেশ ধীরগতি ছিল। সব মিলিয়ে ছয় মাসের হিসাবে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বেহাল দশা হয়েছে।”
এডিপি বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃচ্ছসাধন করা হয়েছে। গত বছরও (২০২২-২৩ অর্থবছর) কৃচ্ছসাধনের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু এই বছর সেই নির্দেশনার বাস্তবায়নটা বেশি হয়েছে।
“গত বছরও কৃচ্ছতা সাধারণের একই নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরকারের জন্য কিছু গাড়ি ক্রয় করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর সরকারি গাড়ি কেনা একদম বন্ধ রয়েছে।”
তাছাড়া সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং চলতি অর্থবছরে শেষ হবে-এমন প্রকল্প ছাড়া অন্যগুলোতে অর্থছাড় কম করার নির্দেশনার কথাও তুলে ধরেন সচিব।
গত ২৪ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের সভায় প্রকল্প বাস্তবায়ন মনিটরিং জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থবছরের বাকি সময়ে মনিটরিং জোরদার হলে শেষ পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়ন বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গড় বাস্তবায়ন হয়েছে ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সরকার দুই লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার যে এডিপি অনুমোদন দিয়েছে, তাতে ৮০ শতাংশই বরাদ্দ পেয়েছে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে সেতু বিভাগ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩২ দশমিক ০৩ শতাংশ বরাদ্দ ব্যয় করতে পেরেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩০ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে।
এরপরে রয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাস্তবায়ন করেছে ২৭ দশমিক ১৬ শতাংশ; বিদ্যুৎ বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২১ দশমিক ০৩ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ১৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, শিল্প মন্ত্রণালয় ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করেছে মাত্র ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।
কমেন্ট