‘সংসারই চলছে না, সঞ্চয়পত্র কিনবে কি দিয়ে’
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)। এর মানে হচ্ছে—এই ছয় মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ৬ হাজার ৬৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।
চলতি অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস ডিসেম্বরে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা বেশি।
অর্থাৎ গত বছরের শেষ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)। অথচ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে এই খাতে বিনিয়োগ বেশ বেড়েছিল।
প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই বিক্রির অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ঋণাত্মক (-) ধারায় ফেরে; ওই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৪৮ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)।
সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক (-)। এর মানে হচ্ছে—এই ছয় মাসে যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ৬ হাজার ৬৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার।
এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করা হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ির কারণে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশ কমে গিয়েছিল; বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (গত বছরের জুলাই ও আগস্ট) বিক্রি বেশ ভালোই বাড়ছিল। সেপ্টেম্বরে এসে ফের ধাক্কা খায়।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।
এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’বা ‘ধার’হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাহলে বলা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ‘ঋণ’বা ‘ধার’ নিতে পারেনি। উল্টো ৬ হাজার ৬৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ দিতে হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
নানা ধরনের কড়াকড়ি, সুদের হার হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ে টান পড়ায় বিক্রি কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে কাঙ্খিত ঋণ পাচ্ছিল না সরকার। সে কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
কিন্তু অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধ এবং ভাঙ্গানো বাবদ ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা ঘটে। প্রতি অর্থবছর আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ এবং জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকরা মেয়াদ পূর্তির আগেই যে সব সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গান-সেই অর্থের পরিমাণ নতুন করে মোট যতো টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি হয়।
কিন্তু গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার উল্টোটা হয়। ওই অর্থবছরে মোট বিক্রির চেয়ে সবকিছু শোধের পরিমাণ বেশি ছিল। সে কারণে গত অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারিনি।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে অতিমাত্রায় ব্যাংক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়েছে। তাই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৮০ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। এর বিপরীতে সুদ-আসল পরিশোধ ও ভাঙ্গানো বাবদ মোট চলে যায় ৮৪ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এ হিসাবেই গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) হয়েছিল।
এর আগে ২০২১–২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছিল সরকার। ২০২০–২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সুদের হার হ্রাস ও নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গিয়েছিল। সে কারণেই গত অর্থবছরে নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছিল।”
“এবার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুদিন ধরে সাড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠানামা করছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছিল; ডিসেম্বরে অবশ্য ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। মানুষ যা আয় করছে, তা নিয়ে সংসারই চলছে না। সঞ্চয় করবে কিভাবেঃ সঞ্চয়পত্র কিনবে কী দিয়ে?”সে কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে মনে করেন আহসান মনসুর দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িদ্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
একই কথা বলেছেন আরেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এখনও যে কোনো স্কিমের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। কোনো ঝামেলাও নেই; অনলাইন করায় প্রতি মাসের মুনাফা অটোমেটিক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে চলে আসে। মেয়াদপূর্তির পর আসলও চলে অ্যাকাউন্টে। তার পরও মানুষ আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনছে না; কিনছে না বললে ভুল হবে। কিনতে পারছে না। কেননা, বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে সন্তানদের শিক্ষা খরচ; চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
“অনেকে মেয়াদপূর্তির আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। সঞ্চয় করবে কিভাবে; সঞ্চয়পত্র কিনবে কি দিয়ে।”
‘তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমায় সরকারের একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে’ জায়েদ বখত বলেন, “এতে সরকারের ভবিষৎ ঋণের বোঝা কমবে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য বলছে, গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এর পর থেকে বিক্রি কমতে থাকে।
গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরেছে সরকার।
কিন্তু অর্থবছরের ছয় মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেনি সরকার। উল্টো ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে।
কমেন্ট