ডব্লিউটিও সম্মেলনে ২০৩২ পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে অব্যাহতি চাইবে বাংলাদেশ
২৬-২৯ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরতের রাজধানী আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলনে ডব্লিউটিওর সদস্য ১৬৪টি দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীরা অংশ নেবেন।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১৩তম সম্মেলন বসছে সোমবার। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল হিসেবে উত্তরণের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই সম্মেলনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২৬-২৯ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরতের রাজধানী আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সম্মেলনে ডব্লিউটিওর সদস্য ১৬৪টি দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীরা অংশ নেবেন। এই সম্মেলনে যোগ দিতে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের শনিবার ঢাকা ছেড়েছেন।
সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে অব্যাহতি চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
স্বল্পোন্নত বা এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব-সম্পর্কিত চুক্তির বিধিবিধান বা ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) পরিপালনে অব্যাহতি পেয়ে আসছে।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হলে এ সুবিধা না থাকার কথা। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হলেও স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে বাংলাদেশের ওই সুবিধা দরকার। এমন বাস্তবতায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এবারের সম্মেলনে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্বে অব্যাহতি চাইবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এবারের সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল।
বর্তমানে ১৬৪টি দেশ ডব্লিউটিওর সদস্য। সংস্থায় এলডিসি গ্রুপের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণ পর্যায়ে থাকায় এবারের সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছরের অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ডব্লিউটিওর সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশসহ যারা এলডিসি থেকে বের হবে, তাদের পণ্য আমদানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বাড়তি কত বছর সুবিধা থাকবে তা মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে নির্ধারিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ বাড়তি ছয় বছর করার প্রস্তাব করবে। ইতোমধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও যুক্তরাজ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওষুধশিল্পে ট্রিপস সুবিধা না থাকলে দেশে উৎপাদিত অন্তত ২০ শতাংশ ওষুধে পেটেন্ট প্রযোজ্য হবে। এতে দাম বেড়ে যাবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক হিসাবে এ কারণে ইনসুলিন তৈরিতে খরচ আট গুণ পর্যন্ত বাড়বে।
বাংলাদেশ বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই কোনো কোনো দেশ কয়েকটি পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। এ অবস্থায় খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে তা এলডিসি দেশের ক্ষেত্রে কার্যকর না করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।
এ ছাড়া বিধি অনুযায়ী কোনো দেশ কোনো পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে ডব্লিউটিওকে জানাতে হয়। কিন্তু অনেক সময় অধিকাংশ দেশ না জানিয়েই রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ কারণে রপ্তানি বন্ধের আগে নোটিফিকেশন জারির বাধ্যবাধকতা আরোপের দাবি তোলা হবে এবারের সম্মেলনে।
এদিকে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কৃষি ও মৎস্য খাতে ভর্তুকি নিয়ে চাপ থাকবে। এ বিষয়েও এলডিসির পক্ষ থেকে ছাড় চাওয়া হবে। বিশেষ করে মৎস্য খাতে ভর্তুকির বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাড়তি শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার পাশাপাশি ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্বে ছাড় চাওয়া হবে। একই সঙ্গে ভোগ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধের আগে জানানো এবং এলডিসি দেশগুলোকে এর বাইরে রাখার দাবিও তোলা হবে।”
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তাফা আবিদ খান বলেন, “এগুলো যৌক্তিক দাবি। এসব দাবি উপস্থাপনের পাশাপাশি এর সপক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নানা ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার ক্ষেত্রেও প্রস্তুতি নিতে হবে।”
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশকে তিনটি স্বার্থ নিয়ে কাজ করতে হবে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলডিসির সব সুবিধা পাওয়া, এরপর আরও তিন বছর এলডিসি সুবিধা পাওয়া এবং উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার পরের সুবিধার জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়া। মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় খেয়াল রাখতে হবে উন্নয়নশীল দেশের জন্য কী কী সুবিধা আসছে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় কয়েক দফা স্থগিত থাকা দ্বাদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন ২০২২ সালের জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা— সব মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। এটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তার কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ পরিচয়ে এটিই বাংলাদেশের শেষ সভা হতে পারে।
ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা— সব মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। এটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তার কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ পরিচয়ে এটিই বাংলাদেশের শেষ সভা হতে পারে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ উদযাপনের ২০২১ সালে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের অনুমোদন। কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যেও এই অর্জন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে এনে দেয় এক নতুনমাত্রা।
সেই ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হবে। তবে টানা চতুর্থবার সরকারে আসা আওয়ামী লীগ চাইছে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মেয়াদ বাড়াতে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সকল দেন-দরবারে ভবিষ্যৎ উন্নয়নশীল দেশের আগ্রহের জায়গাগুলো খেয়াল রেখে করতে হবে।”
বাণিজ্য সুবিধা সম্প্রসারণের দাবি বাস্তবায়নে সরকারের প্রস্তুতির প্রসঙ্গ টেনে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর বলেন, “এক্সপানশনের (বর্ধিতকরণ) সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশ চাইলে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও তা হতে পারে।”
কমেন্ট