১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি
গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে ওঠে। এরপর তা আর কোনো মাসেই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতি ফের চড়েছে।
গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে ওঠে। এরপর তা আর কোনো মাসেই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অর্থাৎ ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। সবশেষ গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সপ্তাহে মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিবিএসের সবশেষ হিসাব অনুসারে, মার্চে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। এ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ ও ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি চাহিদাতাড়িত নয়; এটি বাড়তি উৎপাদন খরচতাড়িত মূল্যস্ফীতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, কিন্তু আমরা পারছি না।”
শামসুল আলমের মতে, প্রাথমিক পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমতে আরও এক বছর লাগবে। এ জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি বাড়লে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বাড়ে। এমনিতেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া।
তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মার্চে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় ধরনের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল গত মাসে রোজা উপলক্ষে নতুন করে চাল, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছিল।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, মার্চে গ্রামের তুলনায় শহরে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ছিল। এ মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মার্চে শহরাঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশে ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭১ শতাংশে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৬৯ শতাংশ
১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম
আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, মার্চে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস।
মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।
কমেন্ট