দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা

দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা

অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তবে বেড়েছে কৃষি খাতের অবদান।

সংকটের মধ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যা প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চেয়ে প্রায় অর্ধেক; ওই তিন মাসে ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।

অর্থবছরের সাড়ে দশ মাস চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তবে বেড়েছে কৃষি খাতের অবদান।

বিবিএস প্রান্তিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব করে, তাতে উল্লেখিত তিনটি খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ তিন খাতের মধ্যে বড় দুই খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় সার্বিক প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে।

শুধু গত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায়ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে পৌনে ৪ শতাংশের কাছাকাছি নেমে গেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক তথা অক্টোবর-ডিসেম্বর—এ তিন মাসে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। তার আগের অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ।

আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। সেই হিসাবে গত তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে।

বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে। গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।

আর ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

কৃষি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও শিল্পের মতো সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে। এ তিন মাসে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

শিল্প ও সেবায় প্রবৃদ্ধি কমার যত কারণ

শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির চলমান বিভিন্ন সংকটকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি চাহিদাও কমেছে।

একইভাবে সেবা খাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য ভোক্তা চাহিদা কমে গেছে। এ সময়ে ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশীয় অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি কম ছিল, যার প্রভাব শিল্প খাতের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যে প্রবৃদ্ধি কম হবে-এটাই স্বাভাবিক। এখন দেখা যাক, বাকি দুই প্রান্তিকে কি হয়।”

“আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি—সংকটের এই সময়ে আমরা যদি ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারি তাও যথেষ্ট। প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে এখন আমাদের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে হবে। ডলারের বাজার স্বাভাবিক করতে হবে।”

তিনি বলেন, কাঁচামালসংকট, ডলার–সংকট ও উচ্চমূল্য এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে শিল্পের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।

“সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ সময়ে চিকিৎসা থেকে শুরু করে পরিবহন, আবাসন, বিনোদনসহ সেবা খাতের সব ধরনের খরচ বেড়ে গেছে। যার ফলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এসব সেবা ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। যার প্রভাবে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।”

কৃষি খাত ভালো করেছে

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত যে সংকট মোকাবিলা করছে, সে তুলনায় কৃষি খাতে সংকট কম ছিল। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে কৃষিপণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে।

একই সঙ্গে সবজি থেকে শুরু করে দেশে উৎপাদিত সব ধরনের কৃষিপণ্যের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এতে কৃষকসহ কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষই কমবেশি লাভবান হয়েছে। যার ফলে এ খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

আবার কৃষি খাতের উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপও এ খাত–সংশ্লিষ্টদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।

এ বিষয়ে আহসান মনসুর বলেন, অর্থনীতির সংকটের মধ্যেও কৃষি খাতে সার, বীজ, পানিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ঠিক রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। শিল্প ও সেবা খাত সংকটের যতটা প্রভাব ছিল, তার তুলনায় কৃষি উৎপাদনে কম ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে এ খাতের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ফলে এ খাতের মূল্য সংযোজন বেশি ছিল।

“কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়া অর্থনীতি ও দেশের জন্য ইতিবাচক দিক। এ খাতের প্রবৃদ্ধি যত বাড়বে, খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তত কমবে, বলেন তিনি।

চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। অর্থনীতির চলমান এ অবস্থায় তা অর্জিত হওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বাজেট ঘোষণার পর থেকেই সংশয় প্রকাশ করে আসছেন।

অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রণালয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানো হবে বলে জানিয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রান্তিকভিত্তিক (তিন মাস পরপর) জিডিপি হিসাব প্রকাশ করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরপর ২১ নভেম্বর ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস।

প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দিয়েই শুরু করে পরিসংখ্যান ব্যুরো; ১৬ ফেব্রুয়ারি ওই তথ্য প্রকাশ করা হয়।

এর ফলে এখন প্রতি অর্থবছরে চারবার জিডিপির হিসাব পাওয়া যাবে। প্রতিবার আগের তিন মাসের জিডিপির গতিপ্রকৃতির চিত্র মিলবে। পরে বছর শেষে তা গড় করা হবে।

দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব করার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন দেশের গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা। দুই বছর আগে এ নিয়ে উদ্যোগও গ্রহণ করে বিবিএস। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনও নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এই ঋণের দুই কিস্তি ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার।

ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ বলেছে, তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রস্তুত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমশক্তি জরিপও প্রান্তিকভিত্তিক করতে হবে।

সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিকভিত্তিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ শুরু হয়েছে।

এতদিন পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেওয়া হত। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব।

তিন মাস পরপর জিডিপিতে সুবিধা

প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশের নানা ধরনের সুবিধা আছে। সাধারণত কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতের মূল্য সংযোজন দিয়ে জিডিপির হিসাব করা হয়। এ জন্য মোটাদাগে ১৯টি খাতের তথ্য–উপাত্ত নেওয়া হয়। এ তালিকায় আছে কৃষি, প্রাণিসম্পদ, কলকারখানা, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পরিবহন, শিল্প-সংস্কৃতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদি।

তিন মাস পরপর হিসাব প্রকাশ করা হলে এসব খাতের মূল্য সংযোজন কত হলো, তা জানা যাবে। কোনো খাতের মূল্য সংযোজন কমে গেলে, সেই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যাবে।

আহসান মনসুর বলেন, “প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি হিসাব করলে নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।”

জিডিপির আকার

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে স্থিরমূল্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ১১ লাখ ২৬ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা।

১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি পরবর্তী

১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি

কমেন্ট