জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাল আইএমএফ-এডিবি
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
আইএমএফ বলেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশে উঠতে পারে। আর ২০২৮-২৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৭ শতাংশে।
মঙ্গলবার আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এপ্রিল সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সদর দপ্তরে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল এই দুই সংস্থার বসন্তকালীন বৈঠক চলাকালে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অর্জিত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। মঙ্গলবার তা কমিয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে নামানো হয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকতে পারে। এই অবস্থায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে।
আরেক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে। গত ১১ এপ্রিল প্রকাশিত এপ্রিল মাসের ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে এডিবি জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
এর আগে ডিসেম্বর মাসে এডিবি বলেছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ২ তাংশ। তার আগের পূর্বাভাসে তারা বলেছিল, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পরবর্তী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
এদিকে আরেক উন্নয়ন-সহযোগী বিশ্বব্যাংক চলতি মাসেই জানিয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আগেও অবশ্য এই একই পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
যদিও চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে। আইএমএফ, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সরকার প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, নানা ধরনের সংস্কার প্রবৃদ্ধির আগের ধারা ফিরিয়ে আনতে পারে। এ জন্য মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা; মুদ্রা ও আর্থিক নীতি কঠোর করা; ব্যাংক খাত সংস্কারে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা
সংকটের মধ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যা প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চেয়ে প্রায় অর্ধেক; ওই তিন মাসে ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।
অর্থবছরের সাড়ে নয় মাস চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তবে বেড়েছে কৃষি খাতের অবদান।
বিবিএস প্রান্তিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে হিসাব করে, তাতে উল্লেখিত তিনটি খাতকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ তিন খাতের মধ্যে বড় দুই খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় সার্বিক প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে।
শুধু গত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় নয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায়ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে পৌনে ৪ শতাংশের কাছাকাছি নেমে গেছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক তথা অক্টোবর-ডিসেম্বর—এ তিন মাসে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। তার আগের অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ।
আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। সেই হিসাবে গত তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে।
বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে। গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
আর ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
কৃষি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও শিল্পের মতো সেবা খাতের প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গেছে চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে। এ তিন মাসে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। তার আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
গড় মূল্যস্ফীতি হবে ৯.৩ শতাংশ
জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিরও পূর্বাভাসও দিয়েছে আইএমএফ। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে। ২০২৮-২৯ অর্থবছরে তা আরও কমে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসবে।
অক্টোবরের প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছিল, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ হতে পারে। মঙ্গলবার বলেছে, ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশের উপরে ওঠে। এরপর তা আর কোনো মাসেই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অর্থাৎ ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। সবশেষ গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সপ্তাহে মূল্যস্ফীতি নিয়ে যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিবিএসের সবশেষ হিসাব অনুসারে, মার্চে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়েছে। এ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ ও ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল দশার কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
কমেন্ট