বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ

বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ

জুলাই-মার্চ সময়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১১৭ দশমিক ১০ শতাংশ; আসল বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।

বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের সুদ বাবদ ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার (১.০৫ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।

এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই নয় মাসে সুদ বাবদ ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সোমবার বিদেশি ঋণের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

সুদের হার বাড়ায় বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের অঙ্ক বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাজার-ভিত্তিক ঋণ ক্রমগত বাড়ছে। এই ঋণের সুদহার এখন ৫ শতাংশের মতো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই সুদহার ছিল ১ শতাংশের কিছু বেশি। এ কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বলে জানান আহসান মনসুর।

বৈশ্বিক সুদহার নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফারড রেটের (লাইবর) ব্যবহার শেষ হয় ২০২৩ সালে ৩০ জুন। এর মাধ্যমে প্রায় ৪০ বছর ধরে চলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার নির্ধারণের অন্যতম ওই মাপকাঠির ইতি ঘটছে।

এর পরিবর্তে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (সোফর) নামে নতুন ব্যবস্থা চালু হয়। বাংলাদেশকে এখন সোফর রেটেই বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতে সোফর রেট বেড়েছে। বর্তমানে সোফর সুদহার ৫ শতাংশের কিছু বেশি। এক বছর আগে এই সুদহার ছিল ১ শতাংশের কিছু বেশি।

ইআরডি’র তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার (২.৫৭ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এর মধ্যে আসল বাবদ শোধ করা হয়েছে ১৫১ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার (১.৫১ বিলিয়ন) ডলার বা ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার (১.০৫ বিলিয়ন) ডলার বা ১১ হাজার ৬০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ-আসল বাবদ ১৭৩ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার (১.৭৩ বিলিয়ন) ডলার বা ১৬ হাজার ৯৬৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে আসল বাবদ শোধ করা হয়েছিল ১২৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার (১.২৪ বিলিয়ন) ডলার বা ১২ হাজার ২০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সুদ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-মার্চ সময়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১১৭ দশমিক ১০ শতাংশ; আসল বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।

ঋণ বেড়েছে ৫ শতাংশ

ইআরডি’র তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ (৫.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের এই নয় মাসে ৫৩৬ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার (৫.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।

জুলাই-মার্চ সময়ে ৫ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ৫৩০ কোটি ৪০ লাখ ২০ হাজার (৫.৩০ বিলিয়ন) ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ৩২ কোটি ৭৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার অনুদান। অনুদানের মধ্যে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার প্রকল্প সহায়তা। আর ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার খাদ্য সহায়তা।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ৫০১ কোটি ৬৯ লাখ ৭০ হাজার (৫.০১ বিলিয়ন) ডলার প্রকল্প ঋণ। আর ৩৪ কোটি ৬০ লাখ ৬০ হাজার ডলার অনুদান। অনুদানের মধ্যে ৩০ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ডলার প্রকল্প সহায়তা। ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার খাদ্য সহায়তা।

প্রতিশ্রুতি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার (৭.২৪ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা।

গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রতিশ্রুতির অঙ্ক ছিল ৩০৭ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার (৩.০৭ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই নয় মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দাতাদের ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ১৩৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা দ্বিগুণেরও বেশি।

সবচেয়ে বেশি দিয়েছে এডিবি

ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, এই নয় মাসে সবচেয়ে বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে; ১৪০ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার (১.৪০ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে সংস্থাটি। যা মোট ঋণ-সহায়তার ২৫ শতাংশ।

আরেক উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) দিয়েছে ১৩৫ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার (১.৩৬ বিলিয়ন) ডলার। বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ৯৬ কোটি ৭৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে রাশিয়া ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, চীন দিয়েছে ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। ভারত দিয়েছে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ ১০ হাজার ডলার।

সংকট কাটাতে আরও ঋণ প্রয়োজন

দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে কম সুদের আরও বেশি বিদেশি ঋণ-সহায়তার প্রয়োজন বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “গত ডিসেম্বরে আইএমএফ, এডিবি ও কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ায় আমাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেশ খানিকটা বেড়েছিল। এখন আবার কমে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। তখন রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়বে।”

এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভের পতন ঠেকাতে কম সুদের বিদেশি ঋণের দিকে এখন সরকারকে সবচেয়ে বেশি ‘জোর’ দেওয়ার পরামর্শ দেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

বলেন, “আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে সস্তা ঋণের পরিমাণ কমছে। বাজার ভিত্তিক ঋণ ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। এসব ঋণের সুদহার বেশি, আবার পরিশোধের সময়ও কম থাকে। আবার আমাদের অনেক মেগা প্রকল্পের জন্য নেওয়ার ঋণের গ্রেস প্রিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় সুদ-আসল পরিশোধের চাপও বেড়েছে এবং আগামীতে এই চাপ আরয় বাড়তে থাকবে।”

“এ অবস্থায় রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বাড়তে হবে," যোগ করেন তিনি।

৪৫ টাকা কেজি দরে চাল কিনবে সরকার পরবর্তী

৪৫ টাকা কেজি দরে চাল কিনবে সরকার

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর