খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশ: বিআইডিএস
অতীতে কোনও কোনও মাসে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করতে দেরি করেছে বিবিএস। পরে যখন প্রকাশ করা হতো, তখন দেখা যেতো অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক বেড়েছে। এবার এপ্রিল মাসের তথ্য প্রকাশে দেরি হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এপ্রিল মাসের মূল্যস্ফীতি কি বেড়েছে?
মে মাসের ৯ দিন চলে গেল। কিন্তু আগের মাস এপ্রিলের মূল্যস্ফীতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তা এখনও প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সাধারণত মাস পেরুলে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস।
অতীতে কোনও কোনও মাসে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করতে দেরি করেছে বিবিএস। পরে যখন প্রকাশ করা হতো, তখন দেখা যেতো অর্থনীতির স্পর্শকাতর এই সূচক বেড়েছে। এবার এপ্রিল মাসের তথ্য প্রকাশে দেরি হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এপ্রিল মাসের মূল্যস্ফীতি কি বেড়েছে?
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চালঞ্চ্যকর তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ।
বিআইডিএসের একটি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাড়তি এ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়ে এক বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিনায়ক সেন বলেন, “সম্প্রতি বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ।”
সাধারণত মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। তবে বিআইডিএস পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছে। বিবিএসের সবশেষ হিসাবে, গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বলছে, মার্চ মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৪৪ ও ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, “আমাদের পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। এরপর রয়েছে পোল্ট্রি মুরগির দাম।”
দেশের পোল্ট্রি খাদ্যের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। গত দুই বছরে আমদানি করা এসব খাবারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
বিনায়ক সেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সুদহার বাড়ানো বা এ রকম পৃথক পদক্ষেপ নিলে হবে না। এর সঙ্গে শুল্ক কমানোসহ সমন্বিতভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাদ্যে শুল্ক কমানো প্রয়োজন। এটি কমানো হলে তা মাছ ও মুরগির মতো পণ্যের দাম কমাতে সহায়ক হবে। এতে মূল্যস্ফীতিও কমবে। এ খাতে শুল্ক কমিয়ে অন্য খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।
`বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন। বইটি লিখেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান।
`চুন খেয়ে গাল পোড়ে, দই দেখে ভয় করে’
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অর্থনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা সব সময় নরম ভাষায় কথা বলেন। এটা ভালো। কিন্তু যারা ঋণ খেলাপি হচ্ছে, দিনদুপুরে ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে, তাদের কেন সরাসরি ডাকাত বলেন না। ডাকাতদের তো ডাকাতই বলতে হবে।”
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে এম এ মান্নান বলেন, “এমন সব প্রকল্প নিয়ে আসা হয়, যেগুলোর জন্মই আজন্ম পাপ। এমন সব প্রকল্প বড় অর্থায়ন দিয়ে পাস করি আমরা। এগুলো নিয়ে বলা হয়, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ছে; সুনির্দিষ্টভাবে প্রকল্প ধরে কেউ কথা বলেন না। এগুলো নিয়ে আপনারা (অর্থনীতিবিদেরা) কথা বলবেন।”
অনুষ্ঠানে বিনায়ক সেন বলেন, “খেলাপি ঋণ কমাতে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনতে বহুদিন ধরে ব্যাংকিং কমিশন করার কথা বলা হচ্ছে। এখানে কেউ হাত দিচ্ছি না। ব্যাংকিং কমিশন না করলে অন্তত ব্যাংকিং কমিটি গঠন করা হোক।”
এ বিষয়ে এম এ মান্নান বলেন, “আমাদের অবস্থা হয়েছে, চুন খেয়ে গাল পোড়ে, দই দেখে ভয় করে। জীবনে অনেক কমিশন দেখেছি। খুঁজে খুঁজে বুড়ো লোকদের, অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের পদপদবি দিয়ে বসানো হয়, বড় ভবনে জায়গা দেওয়া হয়; কিন্তু ফল কী হয়? সুতরাং কমিশন নয়, সরাসরি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।”
পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, “ব্যাংক খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে হাত দিতে হবে। ব্যাংকগুলো এত দিন যেভাবে চলেছে, সেভাবে চলতে দিলে আমরা ঋণখেলাপি কমার আশা করতে পারি না।”
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন।
কমেন্ট