২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫.৭% প্রবৃদ্ধি হবে: বিশ্বব্যাংক
বিশ্বব্যাংক বলেছে, ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। তাদের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অর্জিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক জুন মাসের প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে সংস্থটির সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সামনের দিনগুলোতে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটুকু এবং কীভাবে এগোবে সেই আভাসও দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। তাদের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) হিসাব কষে বলেছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখনও পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও কমবেশি লাগছে। ডলারের দর বেড়েই চলেছে; ৮৬ টাকার ডলার এখন ১১৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ডলারের এই উল্লম্ফনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়ছে। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততই বাড়ছে।
এমন একটি কঠিন সময়ে গত ৬ জুন আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এই বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকার তাদের গৌরবের অর্জন হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বরাবরই দেখিয়ে আসছে।
করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর যা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।
তার পরের বছর কোভিড মহামারির ধাক্কায় তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। পরের বছর ৭ শতাংশ ছাড়ালেও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যায়; পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আগের বারের (২০১৯-২০) মতো ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
করোনার ধাক্কায় ওই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছিল। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে গত এপ্রিলে দেওয়া আভাসই বজায় রেখেছে বিশ্বব্যাংক। তাদের প্রাক্কলন বছর শেষে তা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে।
একটি দেশে এক অর্থবছরে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয়, তার সামষ্টিক বাজার মূল্যই হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিম্নগামিতা কাটিয়ে প্রায় স্থিতিশীল হয়ে উঠবে; সামান্য বাড়বে। পরের অর্থবছরে (২০২৫-২৬) প্রবৃদ্ধি আরও একটু বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হবে।
মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা-ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং বড় বিনিয়োগের প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামগ্রিক বিনিয়োগ বাড়বে। এ বছরে অভ্যন্তরীণ যোগান ও আমদানি পণ্যের সংকট ধীরে ধীরে কাটতে থাকবে।
মুদ্রার ‘উদার’ বিনিময় হারের কারণে আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহও বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা দায় শোধের চাপেও ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
গত কয়েক বছর আওয়ামী লীগ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরলেও এবার কিছুটা রাশ টেনে ধরেছে। এই পিছিয়ে আসার স্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বাজেট উপস্থাপনায় তিনি বলেন, “২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ গতি ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে যৌক্তিক সকল সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে।
“পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রপ্তানি ও প্রবাস আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আশা করছি আমাদের গৃহীত এসকল নীতিকৌশলের ফলে আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মধ্যমেয়াদে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে।”
‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে আমদানি নিষেধাজ্ঞা থাকায় শিল্প–কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি কেনাকাটা ও বিনিয়োগের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একভাবে চলে যাচ্ছে, কিন্তু উচ্চমূল্যের কারণে মানুষের প্রকৃত মজুরি ও পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এতে ব্যক্তি মানুষকে ভোগের রাশ টানতে হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সরকার দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ঋণের সুদহার বেড়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে; টান পড়ছে চাহিদায়।
দেশের ব্যাংকিং খাতে যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে, তা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। মূল্যস্ফীতির হার কমে এলে ব্যক্তিপর্যায়ের ভোগ কিছুটা স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছে তারা। সেই সঙ্গে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগেও গতি আসবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেসব বাধা আসতে পারে, বিশ্বব্যাংক সেগুলোও আলোকপাত করেছে। বলেছে, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে এক দেশের সমস্যা কেবল সেই দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমলে তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত থাকবে না।
যেমন—চীন বাংলাদেশের আমদানির মূল উৎস। চীনের অর্থনীতি গতি হারালে মধ্যবর্তী পণ্য ও উপকরণ আমদানিতে প্রভাব পড়বে। আরেক দিকে বাংলাদেশের রপ্তানির মূল গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে প্রত্যাশিত চাহিদা না থাকলে রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ আরও কিছু ঝুঁকির কথা বলেছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে
বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত তিন বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি এবারই প্রথম স্থিতিশীল হবে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে ভারতের, ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ও ভুটানের একই হারে অর্থাৎ ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে।
এ ছাড়া নেপালের ৪ দশমিক ৬ ও পাকিস্তানের ২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
কমেন্ট