পেনশন স্কিমের টাকা কোথায় বিনিয়োগ হবে
গেজেট অনুযায়ী, পেনশন কর্মসূচির আওতায় জমা হওয়া অর্থ বিনয়োগে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে।
আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায়নি সরকার। এই স্কিমের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা হবে তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে পেনশন স্কিমে জমা হওয়া গ্রাহকদের অর্থ কোথায় এবং কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে সে বিষয়টি পরিস্কার করে সরকার একটি বিধি প্রকাশ করেছে।
স্কিম চালুর ১১ মাস পর এর তহবিল বিধিমালার গেজেট জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রবিবার জারি করা গেজেট অনুযায়ী, পেনশন কর্মসূচির আওতায় জমা হওয়া অর্থ বিনয়োগে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ যেন কম ঝুঁকিতে ভালো মুনাফা করতে পারে, সেজন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গেজেটে বলা হয়েছে, সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলসহ সুকুক এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত মিউচুয়াল ফান্ডের মতো সিকিউরিটিজে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। এছাড়া 'ডাবল এ' র্যাংকিংয়ে থাকা ব্যাংকগুলোর স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ করা হবে।
পাশাপাশি তালিকাভুক্ত 'এ' ক্যাটাগরির বন্ড ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকার বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা সিকিউরিটিজেও পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ করা হতে পারে।
এই অর্থ বেসরকারি খাতের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা যাবে না। একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ নেই বিধিমালায়।
এতে বলা হয়েছে, যেকোনো খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ মোট তহবিলের ২৫ শতাংশের কম হতে হবে। তবে সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই ঊর্ধ্বসীমা প্রযোজ্য নয়।
এজন্য একটি অর্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির সভাপতি হবেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য। এছাড়া কমিটিতে পেনশন কর্তৃপক্ষের আরও একজন সদস্য থাকবেন। একইসঙ্গে এই কমিটিতে অর্থ বিভাগের দুজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, অন্তত যুগ্ম সচিব পর্যায়ের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান অথবা বিভাগ থেকে নির্বাচিত একজন অধ্যাপক, বিএসইসি থেকে অন্তত পরিচালক পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি এই কমিটিতে থাকবেন।
পেনশন কর্তৃপক্ষের অর্থ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কমিটির সদস্য সচিব হবেন।
কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো ব্যক্তিকে যোগ করতে পারবে বা আমন্ত্রণ জানাতে পারবে। তবে আমন্ত্রিত ব্যক্তি কেবল তাদের মতামত বা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারবে। তাদের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না।
কমিটি সিকিউরিটিজের সম্ভাব্য মুনাফা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগের সুপারিশ করবে। তারা অর্থ ব্যবস্থাপককে কম ঝুঁকিপূর্ণ, মুনাফা করা সম্ভব—এমন খাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দেবে। একইসঙ্গে এই কমিটি যেকোনো ব্যবসা, অর্থ ও বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়েও পরামর্শ দেবে।
এদিকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করতে ৪ হাজার কোটি টাকার (৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার) একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে ২৫ কোটি মিলিয়ন ডলার দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।
প্রকল্পটির আওতায় পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চলতি বছরের নভেম্বরে প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে এবং শেষ হবে ২০২৮ সালের জুনে।
মূলত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে সরকার পেনশনের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের বোঝা কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের আনফান্ডেড পেনশন সিস্টেম থেকে ফান্ডেড সিস্টেমে স্থানান্তরিত করছে। আনফান্ডেড পেনশন সিস্টেমে অবসর গ্রহণের পর যে সুবিধা দেওয়া হয় সাধারণত তা সরাসরি নিয়োগকর্তা দিয়ে থাকে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে পেনশন ও গ্র্যাচুইটি বাবদ সরকারের ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
তবে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর মানুষ তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তাই প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে সরকার এর কার্যক্রম বাড়ানোর চেষ্টা করেছে।
যদিও দেশের মানুষের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার গুরুত্ব আছে। কারণ কেবল সরকারি খাতের কর্মচারীরা এ সুবিধা পেয়ে আসছে।
এই উদ্যোগকে টেকসই করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রকল্প নথিতে মন্ত্রণালয় বলেছে, এই প্রকল্পটি প্রয়োজনীয়।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “প্রকল্পটি চালু হলে আইটি অবকাঠামো উন্নত হবে। এরপর কর্তৃপক্ষ যেখানে বিনিয়োগ করা দরকার মনে করবে, সেখানে করবে।”
এডিবি মন্ত্রণালয়কে মৌখিকভাবে জানিয়েছে, তারা এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো, দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও সংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং পেনশন প্রকল্প সম্প্রসারণ করা।
এডিবির অর্থায়ন নিশ্চিত করতে এবং চূড়ান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নে উন্নয়ন সহযোগীর মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করতে হবে।
তাই প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়েছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, গবেষণাটি পরিচালনার জন্য পরামর্শক খোঁজা হচ্ছে।
গত বছরের ১৭ আগস্ট ৪টি স্কিম নিয়ে চালু হয় সর্বজনীন পেনশন স্কিম। এ স্কিমগুলো হলো প্রবাস- প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশীদের জন্য, প্রগতি- বেসরকারি খাতে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য, সুরক্ষা-স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য এবং সমতা-দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য।
কমেন্ট