প্রধানমন্ত্রীর বাদ দেওয়া সহকারী জাহাঙ্গীরের ব্যাংক হিসাব জব্দ
জাহাঙ্গীর আলম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকা মালিক হয়েছিলেন- তা নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যেই তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা।
এই জাহাঙ্গীর আলম গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসন থেকে। নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে গত ২৭ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমাও দেন তিনি।
তবে ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে জাহাঙ্গীর আলম অনৈতিক কাজ করছেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনও সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করা হয়েছিল ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
গত ১৭ ডিসেম্বর ছিল সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। সেদিন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা দেওয়ান মাহবুবুর রহমানের কাছে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন জাহাঙ্গীর।
রবিবার চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থানের তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমার বাসায় কাজ করে গেছে; পিয়ন। সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না- হ্যাঁ, বাস্তব কথা। সে কী করে বানালো এতো টাকা?”
ওই পিয়নের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “যখন আমি জানছি তাকে বাদ দিয়ে কার্ড সিজ করে আমার ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। এটা তো হয়, এটা তো করে। ধরার পরে না এগুলো চোখে আসে। তাছাড়া তো হয় না।”
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভির পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ সংবাদ সম্মেলন সরাসরি দেখায়। এর পর প্রধানমন্ত্রীর ওই পিয়ন কে হতে পারেন- তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়।
রবিবার বিকালেই আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী কামরুন নাহারের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রাখতে ব্যাংকগুলোকে ইমেইলে চিঠি দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় বিএফআইইউ। তাদের হিসাব খোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের লেনদেনের তথ্যও দিতে বলা হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকে ধারণা করছেন, প্রধানমন্ত্রী তার যে পিয়নের কথা বলেছেন তিনি এই জাহাঙ্গীর আলম। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও এসেছে। তবে, জাহাঙ্গীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিনি মনে করেন না- প্রধানমন্ত্রী তাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন।
“আমার পুরো বংশেরও মিলেও তো এতো টাকা হবে না। আর আমার কী আছে তাতো ট্যাক্স ফাইলেও উল্লেখ করেছি। আমি দুর্নীতি করিনি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে তার ভাগ্নে চাটখিল পৌরসভার প্যানেল মেয়র মাসুদুর রহমান শিপন সোমবার রাতে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মামা দেশে নাই। আমেরিকা আছে। আজকেই তার দেশে আসার কথা। তবে আজ আসবেন না। কয়েকদিন পরে আসবেন।”
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীর আলম ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’ এর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঢাকা থেকে একবার হেলিকপ্টারে চড়ে নোয়াখালী এসেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরের ভাগ্নে শিপন বলেন, “মামাকে আমি কোনও দিন হেলিকপ্টারে চড়তে দেখিনি। গান্ধী আশ্রমের ওই অনুষ্ঠানে মামা গাড়িতে করে এসেছিলেন।”
সোমবার অফিস শুরুর পর অধিকাংশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিএফআইইউর ওই মেইল দেখতে পান। বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩ (১) (গ) ধারার আওতায় আগামী ৩০ দিন তাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। চিঠিতে আগামী ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের হিসাবের সব তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ।
২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবেই সব জায়গায় পরিচয় দিতেন জাহাঙ্গীর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৯০ দশকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির বাসা সুধাসদনে আসা দলীয় নেতাকর্মীকে পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন জাহাঙ্গীর আলম। নোয়াখালী থেকে আসা এই জাহাঙ্গীরকে নেতাকর্মীরা তখন থেকে ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে চিনতেন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান জাহাঙ্গীর। এরপর থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিতেন। এ পরিচয় দিয়ে তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের গত কমিটির সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন।
জাহাঙ্গীর আলমের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, তার কৃষি খাতে বছরে আয় ৪ লাখ ২২ হাজার ১০৪ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ১১ লাখ ২১ হাজার ৫৩৩ টাকা, ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৮ টাকা। শেয়ার, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের আয় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০ টাকা। চাকরি থেকে ভাতা পান বছরে ৬ লাখ টাকা এবং অন্য উৎস থেকে আয় করেন বছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
তার অস্থাবর সম্পদ হিসাবে নগদ টাকা ও ব্যাংক মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
বন্ড ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার আছে ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৭০০ টাকার, স্ত্রীর নামে আছে ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকার শেয়ার।
জাহাঙ্গীরের সঞ্চয়পত্র আছে ৩ লাখ টাকার, স্ত্রীর নামে আছে আরও ৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।
তার স্ত্রীর একটি গাড়ি আছে, যার মূল্য হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তার স্বর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে ৭৫ তোলা, যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। স্ত্রীর স্বর্ণ আছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকার। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী আছে ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকার, স্ত্রীর নামে আছে ৯ লাখ টাকার।
জাহাঙ্গীর একটি পিস্তল ব্যবহার করেন, যার দাম ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা।
জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ সাড়ে ৪ একর। মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৮২ লাখ ১২ হাজার ১১৫ টাকা। স্ত্রীর আছে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার জমি। তার অকৃষি জমি আছে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা, স্ত্রীর আছে ১৯ লাখ ১০ হাজার টাকার জমি।
জাহাঙ্গীরের ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি ভবন আছে। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে ৭ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে একতলা ভবন মিলিয়ে আছে আড়াই কোটি টাকার সম্পদ।
স্ত্রীর নামে আটতলার এক ভবন আছে, দাম ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরের মিরপুরে আছে দুটি ফ্ল্যাট, যার দাম ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যার দাম ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা।
জাহাঙ্গীরের বড় ভাই মীর হোসেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক সন্তান আর দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তিন সন্তান রয়েছে। প্রথম স্ত্রী দেশে থাকলেও তার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
কমেন্ট