জুলাই-আগস্টের ধাক্কা রাজস্ব আদায়ে, কমেছে ১১%
জুলাই ও আগস্ট মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধাক্কায় সরকারের রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাসের প্রায় পুরোটা সময় দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তারসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। এর পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরও দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে।
সে কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধই ছিল বলা চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়েছে শুল্ক-কর আদায়ে।
এই দুই মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি, উল্টো আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম আয় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি অবশ্য আরও তিন গুণ বেশি—১৫ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধিরা রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এনবিআরের পক্ষ থেকে আইএমএফকে তাদের দেওয়া চলতি অর্থবছরের শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য কমানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। কারণ হিসেবে এনবিআর দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতির কথা উল্লেখ করেছে। গত বৃহস্পতিবার এ বৈঠক হয়।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, অর্থবছরের প্রথম দিকে এমনিতেই রাজস্ব আদায় কম হয়। কিন্তু এবার ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল। জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। অফিস–আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায়নি। এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হয়নি।
তবে সামনের মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় বাড়বে—এমন আশার কথা শুনিয়ে এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “সামনের মাসগুলোতে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে কর কর্মকর্তারা ভয়ডরহীনভাবে কাজ করতে পারবেন। প্রভাবশালী মহল থেকে তদবির থাকে না। এর আগের ২০০৭-০৮ অর্থবছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও লক্ষ্যের চেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর।”
দু্ই মাসে কমেছে ১১.৪৭%, লক্ষ্যের চেয়ে কম ২৬.৩৫%
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় শুল্ক ও কর আদায় ৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা কম হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই দুই মাসে সব মিলিয়ে তারা ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছিল ৪৭ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
শুধু আগের অর্থবছরের তুলনায়ই নয়, গত জুলাই–আগস্টে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। এই সময় এনবিআরকে মোট ৫৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলন, কারফিউ, সরকারি ছুটি, ব্যবসায়ে অনিশ্চয়তা—এসব কারণে লক্ষ্যের চেয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর নির্ধারিত লক্ষের চেয়ে কমেছে ২৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থাটির কর্মকর্তারা মনে করেন, বছরের শেষের দিকে কর আদায়ে গতি বাড়বে। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের বলেছেন, এবারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমবে না।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি, ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর বা মূসক) ও আয়কর—এই তিন খাতের মধ্যে কোনোটিতেই গত দুই মাসে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা গেছে আয়কর খাতে। এই খাতে দুই মাসে ঘাটতি হয় ৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এই খাতে ১৮ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে দুই মাসে আমদানি খাতে ১৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। ভ্যাট খাতে আদায় হয়েছে ১৬ হাজার ২৮ কোটি টাকা, যা ২১ হাজার ১৫১ কোটি টাকার লক্ষ্যের তুলনায় ৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা কম।
রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। তবে তগ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে ১৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিন লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। সে হিসাবে আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। ওই অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা।
আইএমএফের শর্ত
দেশের আর্থিক খাতে ভারসাম্য ঠিক রাখতে ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। ছয় মাস পর ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সংস্থাটি ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ অনুমোদন করে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে এ অর্থ দেওয়ার কথা। ইতিমধ্যে তিন কিস্তিতে ২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
আইএমএফ নানা শর্ত দিয়েই ঋণ অনুমোদন করেছে, যার আওতায় রাজস্ব খাতও রয়েছে। এই খাতের জন্য বড় দুটি শর্ত হলো, প্রতিবছর জিডিপির দেড় শতাংশ পরিমাণ অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় এবং ২০২৭ সালের মধ্যে সব ধরনের করছাড় প্রত্যাহার। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর একটি কৌশলও ঠিক করতে হবে।
এদিকে গত কয়েক বছরে কত শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এই করছাড় যৌক্তিক হারে কমানোর সুপারিশ করেছে আইএমএফের সফররত প্রতিনিধিদলটি।
এনবিআরের শুল্ক বিভাগের হিসাব অনুযাযী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। আয়কর বিভাগও আলাদা হিসাব করেছে। তারা জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তথা করপোরেট করে ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বা ৬৮ শতাংশ এবং ব্যক্তিপর্যায়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বা অটোমেশন ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য আইএমএফ তাগিদ দিয়েছে। এ ব্যাপারে সহায়তা করবে সংস্থাটি।
রাজস্ব খাত সংস্কারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি একটি কৌশলপত্র দেখতে চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এ জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে সংস্থাটি সহায়তা করবে বলে জানায়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড় পেতে চলতি বছরে (২০২৪ সাল) বাংলাদেশকে রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এখন চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড় নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
এছাড়া আইএমএফের শর্ত মেনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তালিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশ, ব্যাংক খাতের তদারকিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি সুদহারের কাঠামো নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ঝুঁকি হ্রাস করার উদ্যোগ নিতে হবে।
কমেন্ট