বন্ধ হবে না পেনশন স্কিম, গতিশীল করবে ইউনূস সরকার
তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে পর স্থবির হয়ে আছে এই কার্যক্রম। গত এক মাসে চারটি পেনশন স্কিমে যোগ দিয়েছেন মাত্র ২০ হাজার জন। যেখানে তার আগের দুই মাসে যুক্ত হয়েছিল ২ লাখের বেশি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের প্রবর্তিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু আছে কি না—তা নিয়ে অনেকের মনে ছিল প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর সম্প্রতি মিলেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সংবাদপত্রে দেওয়া বিজ্ঞাপনে।
বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই পেনশন ব্যবস্থা গতিশীলই করতে চাইছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা। সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই সংবাদপত্র বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার।
তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে পর স্থবির হয়ে আছে এই কার্যক্রম। গত এক মাসে চারটি পেনশন স্কিমে যোগ দিয়েছেন মাত্র ২০ হাজার জন। যেখানে তার আগের দুই মাসে যুক্ত হয়েছিল ২ লাখের বেশি।
গত বছরের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ ছিল, প্রস্তুতি না সেরেই ভোটের আগে জনগণকে তুষ্ট করতে তড়িঘড়ি করে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা- এই চার স্কিম চালু করা হয়। এক বছর পর গত ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থার চাকরিজীবীদের জন্য।
জুলাইয়েই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। তার মধ্যে প্রত্যয় পেনশন স্কিমের বিরোধিতা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরাও ধর্মঘট শুরু করে।
আন্দোলনে দিশেহারা অবস্থায় গত ৪ আগস্ট প্রত্যয় পেনশন স্কিমই বাতিলের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। পরদিন সরকারেরও পতন ঘটে।
এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগও নিয়েছে এই সরকার। ফলে পেনশন স্কিম চালু থাকবে কি না, তা নিয়েও দেখা দেয় সংশয়।
তবে পেনশন কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, প্রত্যয় বাতিল হলেও বাকি চারটি পেনশন স্কিম চালুই থাকছে। আপাতত নতুন কোনও স্কিম নেওয়া হচ্ছে না।
কী সিদ্ধান্ত নিল নতুন সরকার
অন্তবর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে গত সোমবার সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদ বৈঠক করে। সেখানে স্থবির হয়ে পড়া পেনশন স্কিমে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিধিমালা বা আইন সংস্কারের প্রয়োজন হলে তা করার সিদ্ধান্তও হয়।
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সার্বিকভাবে এ কর্মসূচি জোরদার করার বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
পেনশন স্কিমকে আকর্ষণীয় করার ওপর জোর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এজন্য কোনও সংস্কার প্রয়োজন হলে তা করার নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, বিশ্বের সব দেশের পেনশনে সবসময় সংস্কারের সুযোগ থাকে। বিভিন্ন দেশেই কখনও বয়স, কখনও সুবিধা বাড়ে। সামনের দিকে এগুতে পেনশন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে যে কোনও জায়গায় পরিবর্তন আনলে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়বে, তাহলে তা করা হবে।
“আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও যেকোনও সংস্কার বিধিমালা দিয়েই করা সম্ভব। পরিবর্তন আনলে এ কর্মসূচি আরও আকর্ষণীয় হবে। সভায় মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন,” বলেন তিনি।
পেনশন কর্তৃপক্ষ শুরুতে স্থানীয় প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে উদ্যোগ নেওয়ায় অংশগ্রহণ বেড়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানে ভাটা দেখা দিয়েছে। এখন প্রচার বাড়াতে চাইছে সরকার।
গোলাম মোস্তফা বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয়ে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এ কার্যক্রম চাঙা করতে একটু সময় লাগবে।”
অংশগ্রহণে স্থবিরতা
পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্যে দেখা যায়, জুন ও জুলাই এই দুই মাসে চারটি স্কিমে নতুন অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মাত্র ২০ হাজার নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে।
সোমবারের সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ আগস্ট, রবিবার পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৮ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩০ কোটি ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৬৬৯ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে দরিদ্র মানুষ, যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এদের জন্য সমতা স্কিমের মাসিক চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫০০ টাকা স্কিম গ্রহণকারী দিচ্ছে এবং বাকি ৫০০ টাকা দিচ্ছে সরকার। এ স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা এখন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৪ জন। আর জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ৪১ কোটি ৭০ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
পেনশন স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা বাবদ সব থেকে বেশি অর্থ জমা দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরীজীবীরা। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে ইতোমধ্যে চাঁদা জমা পড়েছে ৪৭ কোটি ২৫ লাখ ৫০০ টাকা। এ স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪১০ জন।
চাঁদা দেওয়া এবং নিবন্ধন করা দুদিক থেকেই সবার নিচে রয়েছে প্রবাসীরা। প্রবাস স্কিমে এখন পর্যন্ত ৯১০ জন ৪ কোটি ৮৫ লাখ ২৪ হাজার টাকার চাঁদা দিয়েছে।
এছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষা স্কিমে ৬৩ হাজার ১৭৪ গ্রাহক চাঁদা দিয়েছে ৩৭ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
পেনশন স্কিমের অর্থ বিনিয়োগ করে যে মুনাফা হয়েছে, তা বণ্টনের বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত যে মুনাফা হয়েছে, তার হিসাব করে চলতি মাসেই গ্রাহকদের হিসাবে মুনাফার অর্থ বণ্টন করে দেওয়া হবে। স্কিম গ্রহণকারীরা তাদের হিসাবে ঢুকে জমা করা অর্থের পরিমাণ এবং মুনাফার পরিমাণ দেখতে পারবেন।
কমেন্ট