অস্থিরতায় রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকারের রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাসের প্রায় পুরোটা সময় দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তারসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করে। এর পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরও দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আড়াই মাস পার হলেও দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
এ সব কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, এই তিন মাসে সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।
জুলাই মাসের শুরু থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়। তখন প্রায় সবকিছু বন্ধ ছিল বললেই চলে। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি কারফিউও ছিল বেশ কয়েক দিন। এসবের প্রভাব পড়েছে শুল্ক-কর আদায়ে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকার পরিবর্তনের পরও আবার ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলে জানান এনবিআরের শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তারা।
এনবিআরের হিসাব অনুসারে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই তিন মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর।
তিন মাসেই ধাক্কা
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই তিন মাসেই রাজস্ব আদায়ে মন্দাভাব চলছে। কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেননি কর ও শুল্ক কর্মকর্তারা।
জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পরের মাস আগস্টেও একই অবস্থা দেখা যায়। ওই মাসে ৩১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয় ২১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। ওই মাসে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৯ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ২ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
তিন খাতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
এনবিআর বুধবার রাজস্ব আদায়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর—এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই আগের বছরের চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে, অর্থাৎ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। তিন মাসে ঘাটতি হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ কোটি টাকা কম।
আমদানি খাতে এই তিন মাসে ২৮ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে ভ্যাট বা মূসক আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৩৪ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো কম আদায় হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ও কর, অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন, বছরের শেষের দিকে কর আদায়ে গতি বাড়বে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ধারাবাহিকতায় এনবিআরেরও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি।
এই কমিটির সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে ও পরে দেশের পরিস্থিতি তো আসলেই অস্থির ছিল। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
“এমনিতেই অর্থবছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি থাকে। তারপর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এবার আদায় আরও কমে গেছে।”
কমেন্ট