সরকারের উন্নয়ন কাজে কচ্ছপগতি

সরকারের উন্নয়ন কাজে কচ্ছপগতি

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়নের এই হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্ম।

ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর দেশের ভিন্ন পেক্ষাপটে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে কচ্ছপগতি দেখা দিয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়নের এই হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্ম।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে এডিপিতে মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ খরচ হয়েছিল।

রবিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জ্বালাও–পোড়াও, সংঘাত-সহিংসতা, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নে এই বেহাল দশা বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

আইএমইডি’র ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায় ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল।

মাঠ পর্যায়ের কাজে ঢিমেতালের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেয়।

আইএমইডি’র কর্মকর্তারা বলছেন, আগের সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে চলমান অনেক প্রকল্পের কাজও স্থগিত হয়ে যায়। এসব মিলিয়ে এডিপির বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় কমে যায়।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে টাকার অঙ্কে ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

একক মাস হিসেবে অক্টোবরে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৬৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে ব্যয় হয়েছিল ১১ হাজার ৮২ কোটি ৭০ লাখ টাকা; বাস্তবায়নের হার ছিল ৪ দশমিক ০৩ শতাংশ।

সাধারণত অর্থবছরের প্রথমদিকে এডিপির ব্যয়ের পরিমাণ কম থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার আরও বেশি কম হয়েছে।

এর আগের ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ১৩ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বিগত সরকার প্রথম প্রান্তিক থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিয়ে আসছিল। সবশেষ পাঁচ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারের তোড়জোড়ে এ হার বছর বছর কিছুটা করে বাড়ছিল।

তবে উল্টো ঘটনা ঘটে নির্বাচন সামনে রেখে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সংকোচন নীতি গ্রহণ করায়। এতে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) তা ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশে নেমে আসে।

এরপর চলতি অর্থবছরের শুরুতে প্রথমে সরকারিতে চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং পরে সরকার পতনেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সারাদেশ অচল হয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। এর রেশ পড়ে চলমান প্রকল্পের কাজেও।

অগাস্টে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়ে সরকারের পতন ঘটায়। তিন দিন কার্যত সরকার শূন্য থাকার পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাল ধরে ৮ আগস্ট।

এরপর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পের কী হাল হবে তা নিয়ে বিদেশি সংস্থার মাঝেও দানা বাঁধে শঙ্কা। এর মাঝে আমলাতন্ত্র নতুনভাবে সাজাতে যেয়ে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির মাঝে দায়িত্বরত প্রকল্প পরিচালকরাও নির্দেশনার অভাবে ঢিমেতালে সময় পার করেন।

আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ও নানা শঙ্কায় গা ঢাকা দেন প্রকল্পের ঠিকাদাররাও; এতে পুরোপুরি থমকে যায় প্রকল্পের কাজ।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিফলন পরিসংখ্যানেও পাওয়া যাবে অনুমেয়ই ছিল, হালনাগাদ তথ্যে সেটিই এবার স্পষ্ট হল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম একনেক সভায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগের সরকারের ‘রাজনৈতিক কারণে’ নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনার কথা বলেন।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলেন, “বিগত সরকারের সময়ে একনেক সভায় বিপুল সংখ্যক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের গতি এক থাকত না।

“অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রকল্পও থাকত। এখন সেসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কাজেই আগে একনেক সভা মানেই যেখানে অর্থ ব্যয়ের কর্মযজ্ঞ ছিল, এখন সে পরিধি কমে আসবে।”

এ প্রসঙ্গে আইএমইডি’র সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, "নতুন সরকার সব প্রকল্প পর্যালোচনা করছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর অনেক অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ কারণে এই মুহূর্তে অনেক প্রকল্পে অর্থছাড়ও কম হচ্ছে। এর প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নেও ধীর গতি দেখা দিয়েছে। তবে আশা করা হচ্ছে খুব শিগগিরই উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ প্রবাহ বাড়বে।”

তিনি বলেন, “অর্থবছরের প্রথম দিকে বৃষ্টি এবং প্রস্তুতি পর্ব থাকায় এমনিতেই প্রকল্প বাস্তবায়ন একটু কম থাকে। তার ওপর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় এবারের বাস্তবায়ন আরও কমে গেছে।”

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে বিদায়ী সরকারও কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নিয়েছিল।

“এরই মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই ঘিরে আন্দোলন, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।”

আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে প্রথম জুলাই-অক্টোবর সময়ে সেতু বিভাগ ব্যয় করছে মাত্র ১.১৪ শতাংশ অর্থ। এছাড়া স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ব্যয় করছে বরাদ্দের ২.৪২ শতাংশ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ব্যয় করছে ২.০১ শতাংশ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন হার ২.৯৩ শতাংশ, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৪.৯৩ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৫.৭৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৬.৭৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।

বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যয় করছে ১৩.৯০ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ১০.৪৪ শতাংশ, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১২.৯০ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৯.৬৫ শতাংশ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ১০.৯১ শতাংশ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ১১.৫৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।

রিটার্ন জমার সময় এক মাস বাড়ল পরবর্তী

রিটার্ন জমার সময় এক মাস বাড়ল

কমেন্ট