বিদেশি ঋণের চেয়ে পরিশোধ বেশি
জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ১২০ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে আগে ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। নতুন সরকারের সাড়ে তিন মাস পার হয়েছে। কিন্তু সেই ঋণের এক ডলারও এখনো দেশে আসেনি।
এরই মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পাঁচ মাস (জুলাই-নভেম্বর) শেষ হতে চলেছে। এই সময়ে দাতাদের আগের প্রতিশ্রুত ঋণ প্রাপ্তির অবস্থা হতাশাজনক; যে ঋণ পাওয়া গেছে, তার চেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৃহস্পতিবার চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) মোট ঋণ, প্রতিশ্রুতি ও সুদ-আসল পরিশোধসহ বিদেশি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।
তাতে দেখা যায়, এই চার মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ১২০ কোটি ২০ লাখ (১.২ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে আগে পাওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১৪৩ কোটি ৭৯ লাখ (১.৪৩ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-অক্টোবর সময়ে যতো ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে ২৩ কোটি ৫৯ লাখ ডলার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আসলে বর্তমান সরকারের সমন্বয় ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “দাতাদের কাছ থেকে আমরা কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতেই ঋণ চুক্তি করে থাকি। সেই চুক্তির আলোকেই ঋণ ছাড় করে তারা। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ চললে সেই কাজের বিপরীতে দাতারা অর্থ ছাড় করে। কিন্তু গত চার মাসে দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনও গতি নেই। বিদেশি ঋণনির্ভর কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না।”
“সরকার উল্টো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার দিকেই বেশি মনোযোগী বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি ঋণ ছাড় কম হবে এটাই স্বাভাবিক।”
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ পাচ্ছে তারচেয়ে তাদেরকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ এখন যে ঋণ পাচ্ছে তার চেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ দাতাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ-সহায়তা পেয়েছে পরিশোধ করেছে তার ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে এই চার মাসে বিদেশি ঋণ ছাড় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে ১২০ কোটি ২০ লাখ (১.২০ বিলিয়ন) ডলার ঋণ ছাড় করেছে দাতারা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় করেছিল ১৬২ কোটি ৬২ লাখ (১.৬২ বিলিয়ন) ডলার।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের শুরু থেকে দেশ উত্তাল হয়ে পড়ে। আর ওই মাসে বিদেশি ঋণ ছাড় হয় ৩৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
পরের মাসে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। দুই দিন বাদে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে।
এই মাসে বিদেশি অর্থ ছাড় হয় মাত্র ১০ কোটি ডলার। অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দাতারা ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ডলার ছাড় করেছে। সবশেষ অক্টোবর ছাড় করেছে ৩৫ কোটি ৫৯ লাখ ডলার।
এই চার মাসের প্রতি মাসেই যে বিদেশি ঋণ এসেছে, তার চেয়ে বেশি চলে গেছে আগের ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে।
এভাবে টানা চার মাস বিদেশি ঋণ পাওয়ার চেয়ে বেশি পরিশোধ করা দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সুদ-আসল বাবদ ১১০ কোটি ১৫ লাখ (১.১০ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে সুদ ছিল ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার ডলার। আসল বাবদ শোধ করা হয়েছিল ৬৩ কোটি ৪১ লাখ ডলার।
আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছে ১২০ কোটি ২০ লাখ (১.২০ বিলিয়ন) ডলার। যার মধ্যে আসল ৮৯ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর সুদ ৫৪ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ডলার।
সাধারণত অর্থ ছাড়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমই থাকে, আগের অর্থবছরগুলোতে চিত্র ছিল এমনটাই। তবে দেশের অস্থির সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ বিদেশি অর্থ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ গেছে শোধ করতে।
সবচেয়ে বেশি দিয়েছে জাপান
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সবচেয়ে বেশি ২৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার দিয়েছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ কোটি ১১ লাখ ডলার দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি। তৃতীয় সর্বোচ্চ রাশিয়া দিয়েছে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে ১৭ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ভারত ছাড় করেছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এই তিন মাসে চীন কোনো অর্থ ছাড় করেনি। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৬৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ৯৮৯ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার (৯.৮৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৩৫ কোটি ৭২ লাখ ৩০ হাজার (৩.৩৫ বিলিয়ন) ডলার।
হিসাব করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে মোট ঋণ-সহায়তার ৩৪ শতাংশ চলে যায় আগের নেওয়া ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে। এর মধ্যে আসল ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। আর সুদ ছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯২৬ কোটি ৬৮ লাখ (৯.২৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৯৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। আসল বাবদ শোধ করা হয়েছিল ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিশ্রুতি তলানিতে
ইআরডি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর নতুন করে ঋণ প্রতিশ্রুতি একেবারেই তলানিতে নেমে এসেছে। জুলাই-অক্টোবর—এই চার মাসে মাত্র ২৫ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৬২ কোটি ৮৫ লঅখ (৩.৬৩ বিলিয়ন) ডলার।
অবশ্য এ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই বলে দাবি করেছেন ইআরডির কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী একাধিক খাতে বড় অঙ্কের ঋণ ও বাজেট সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
সেগুলো পাওয়া শুরু হলে বিদেশি ঋণের প্রবাহ বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা।
কমেন্ট