জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথগতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮১ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকের চেয়ে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৬ দশমিক শূন্য চার শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল দেশে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথগতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছরের দুই প্রান্তিক (ছয় মাস, জুলাই-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেষ হয়েছে। সোমবার প্রথম প্রান্তিকের (তিন মাস,জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে টানা তিন প্রান্তিক ধরেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে, কৃষি খাতে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অন্যদিকে, সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যখাত্রমে ৮ দশমিক ২২ ও ৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
বিবিএসের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সার্বিক চিত্র খুবই হতাশাজনক। অর্থবছরের এক প্রান্তিকে জিডিপি এতটা কমে গেছে যে পরের প্রান্তিকগুলোতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি না হলে সার্বিকভাবে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যেতে পারে।”
জুলাই-আগস্টে চাকরিতে কোটাবিরোধী ও পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়েছে, তা ঠেকাতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করা হয়। তখন চলাচল সীমিত করা হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যায়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল দুই সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কিছুদিন আগে এই তিন উন্নয়ন সংস্থাই বলেছে, অনিশ্চয়তার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অনেক কমবে।
গত মাসে আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। তবে সংস্থাটি মনে করে যে আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫–২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে।
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। এডিবি বলেছে, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকার। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের ভেতরে স্থিরমূল্যে ৮ লাখ ৪ হাজার ৯৪২ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়, যা গত ৪ প্রান্তিকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর ১১টি উপখাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে খনিজ ও পাথর উত্তোলন খাতে। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে আর্থিক ও বিমা খাতে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক চতুর্থ বা শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। ওই প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল কৃষি খাতে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর সেবা খাতে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণের তিন কিস্তি ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার। আগামী ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমশক্তি জরিপও প্রান্তিকভিত্তিক করতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিকভিত্তিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ শুরু হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে বিবিএস।
এতদিন পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেওয়া হত। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব।
সে হিসাবেই ২১ মে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে বলে জানানো হয়।
অর্থবছরের সাত মাস (২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ বছরের জানুয়ারি) পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছিল বিবিএস। ওই অর্থবছরের ছয় মাস (২০২৪ সালের ৩০ জুন) পার হয়ে গেলেও জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি পরিসংখ্যান ব্যুরো।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের অর্থনীতিতে একটার পর একটা ধাক্কা লেগেই আছে। সেই যে করোনা মহামারি দিয়ে শুরু হয়েছিল। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; এই যুদ্ধ এখনও চলছে। ধাক্কাও লেগে আছে। এর মধ্যে মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও লেগেছে আমাদের অর্থনীতিতে। সবশেষ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধাক্কা এখনও লাগছে।”
“এ সব কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে কমে যাবে, সেটা সবাই অনুমান করেছিল। বিবিএসের তথ্যে সেটারই প্রতিফলন হয়েছে।
আরেক অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের অর্থনীতিতে এখন ক্রান্তিকাল চলছে। আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। দিন যতো যাচ্ছে, অবস্থা ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে -বড় ব্যবসায়ী কেউই ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না।”
“সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, ২০২৫ সাল দেশের অর্থনীতির জন্য মসৃণ হবে না। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। বন্যার কারণে আমন উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সে কারণে চালের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে। এমন অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কবে কমবে, সেটা একটা চিন্তার বিষয়।”
“বিশ্বব্যাংক বলেছে চলতি অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। আমি বলবো বর্তামান পরিস্থিতিতে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও যদি হয়, তাও ভালো। সেটা হবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।”
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের কি করা উচিৎ—এ প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ হোসেন বলেন, “সবার আগে সব মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর দ্রুততর সময়ের মধ্যে এটা করতে হবে। দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
“অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি কোনো বিনিয়োগই হচ্ছে না। এতে কর্মসংস্থান হবে না। সে কারণে জরুরিভিত্তিতে দেশে বিনিয়োগ অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে,“ বলেন জাহিদ হোসেন।
কমেন্ট