ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে

ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে

ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো—২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, গত বছরের ডিসেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ খানিকটা নেমেছে। সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো—২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, গত বছরের ডিসেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এক যুগেরও বেশি সময়ের মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখেছিল বাংলাদেশ। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।

অক্টোবর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

বিবিএসের মূল্যসস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলে আসছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এই প্রশ্ন বার বার তুলেছেন তারা।

দেশের প্রায় সব অর্থনীতিবিদ বলেছেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে বাস্তবে তা আরও বেশি। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে বাজারের জিনিসপত্রের দামের বাস্তব প্রতিফলন নেই।

একই কথা বলেছে, দেশের অর্থনীতির হালচাল জানার জন্য গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। গত ১ ডিসেম্বর কমিটি অন্তবর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটির হিসাবে দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার এখন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও খসড়া হিসাবের ভিত্তিতে তারা এই পরিসংখ্যান দিয়েছে।

এ পদ্ধতিতে শ্বেতপত্র কমিটির হিসাব, চলতি বছরের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ, মে মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, জুনে ১৫ শতাংশ, জুলাইয়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ, আগস্টে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে দরিদ্র মানুষের জীবনে এর চরম অভিঘাত পড়ছে। বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে সরকারি সংস্থা বিআইডিএস ও ২০২২–২৩ সালে সানেমের জরিপেও এই বিষয়ের সত্যতা উঠে এসেছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক বেশি। এতে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হারেও প্রভাব পড়েছে।

তবে শ্বেতপত্র কমিটি মনে করে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান যে ইচ্ছাকৃতভাবেই কম করে দেখানো হতো, বিষয়টি সে রকম না–ও হতে পারে। বিষয়টি সম্পর্কে তারা ঠিক পরিষ্কারভাবে কিছু বলেনি। বিবিএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শ্বেতপত্র কমিটির মনে হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির অদৃশ্য উচ্চ সীমা ছিল ১০ শতাংশ, এটা মনে করা ভিত্তিহীন নয়। এ ছাড়া পদ্ধতিগত সমস্যা তো আছেই।

দেশে যে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে না, তার সপক্ষে বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, সেই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৫ শতাংশ। যদিও সেই মাসে বিবিএসের হিসাব ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ ছাড়া বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বেশ কিছু নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য হিসাব করে দেখিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের গ্রামাঞ্চলের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও এই সময় সরকারি হিসাব হচ্ছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাসের শুরু থেকে আন্দোলনে পথে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলন ছাত্র থেকে ছড়ায় জনতায়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে দেওয়া হয় ব্লকেড, যাতে অচল হয়ে পড়ে দেশ। ভেঙে পড়ে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশের বাজার ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হয়। যার কারণে বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে এখন কোনো ধরনের কারচুপি করা হচ্ছে না।

গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ব্যাংকিং অ্যালমানাক’র ষষ্ঠ সংস্করণের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “টের পাচ্ছি, কীসের মধ্য দিয়ে গেছে গত ১৫ বছর। মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয়, জিডিপির হিসাব ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তথ্য বিভ্রাটের পেছনে কিছু আছে ভুল হিসাবায়ন, কিছু আছে রাজনীতিবিদদের নেতিবাচক ভূমিকা; প্রকৃত তথ্য লুকানোর চেষ্টা।”

তবে অন্তর্বর্তী সরকার তা করছে না দাবি করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা কোনও পাওয়ার দেখাতে আসিনি, একটা দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। বিগত ১৫ বছরের তথ্য নিয়ে নানা বিভ্রাট রয়েছে। তথ্য লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা এগুলো পরিবর্তন ও সংস্কারের চেষ্টা করছি। কারণ দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কাছে নানা প্রশ্ন করে, তারা বোঝাতে চান আগেই কম ছিল ইত্যাদি। এ নিয়ে আমরা তাদের বোঝাচ্ছি আগের তথ্য লুকানো ছিল, আমরা সঠিকটা উপস্থাপন করছি।”

গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি

ডিসেম্বরে শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ছিল। ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গ্রামীণ এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

আগের মাস নভেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

অন্যদিকে ডিসেম্বরে দেশের শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ; খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।

নভেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

মজুরি সূচক ৮.১৪ শতাংশ

মানুষের আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস।

মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।

বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, গত দুই বছর ধরে মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশে ওঠে।

এভাবে প্রতি মাসেই অল্প অল্প করে বেড়ে অক্টোবরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে ৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ হয়। নভেম্বরে আরও কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ হয়।

জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস পরবর্তী

জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস

কমেন্ট