বড় ঘাটতিতে পড়ে কর বাড়িয়েই চলেছে এনবিআর

বড় ঘাটতিতে পড়ে কর বাড়িয়েই চলেছে এনবিআর

প্রায় অর্ধ শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও শুল্ক-কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর এবার মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পের আয়কর দ্বিগুণ করা হয়েছে।

রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে। এই ঘাটতি মেটাতে ভ্যাট, কর বাড়িয়েই চলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

প্রায় অর্ধ শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও শুল্ক-কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর এবার মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পের আয়কর দ্বিগুণ করা হয়েছে।

ফলে সাধারণ মানুষের খরচ বেড়েই যাচ্ছে; যদিও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমদ বলে আসছেন, এই বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে না।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস করে গেলেও অভ্যুত্থানে এক মাস পরই তাদের পতন ঘটায় বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

ঘোষিত বাজেটে গোটা অর্থ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে পাঁচ মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে তা আদায় করতে না পারায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল।

কিন্তু এবার অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ঘাটতি তার দ্বিগুণ হওয়ায় পুরো বছর শেষে ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সরকারের চিন্তার জন্য যথেষ্ট।

এই ঘাটতি পূরণে অর্থ বছরের মাঝপথে এসে বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক), শুল্ক ও আয়কর বাড়ানোর পথে হাঁটছে অন্তবর্তী সরকার।

এনবিআরে মঙ্গলবার মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পে আয়ের ওপর কর ২০ শতাংশে উন্নীত করার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। এতদিন তা ছিল ১০ শতাংশ।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগামী ২০২৫-২৬ করবর্ষ থেকে নতুন হারে আয়কর ধার্য হবে; অর্থাৎ চলতি অর্থ বছরে এ ধরনের শিল্পের যে আয় হবে, তার ওপর এই বাড়তি কর দিতে হবে।

এসব শিল্প কারখানার যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) দিয়ে আসছে। এই করও বাড়ানোর কথা রয়েছে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন; সেটি বাড়ালে যেদিন থেকে বাড়াবে সেদিন থেকেই কার্যকর হয়ে যাবে।

এসব শিল্প ২০২১ সাল থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২ শতাংশ এআইটি এবং আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর দেওয়ার সুবিধা পেয়ে আসছিল, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা ছিল। সেই আদেশে বাতিল করে এখন নতুন করহার ধার্য করা হল।

মোটরসাইকেল, এসি, রেফ্রিজারেটর ও কম্প্রেসর উৎপাদনকারী কোম্পানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ২৫ শতাংশ ও সাড়ে ২৭ শতাংশ হারে সাধারণ করপোরেট কর প্রযোজ্য।

এ চার ধরনের পণ্যের আয়কর বাড়ানোর ফলে বাড়তি ১ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা আশা করছেন।

৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে।

তারপরই এনবিআর অর্থবছরের মাঝপথে এসে হঠাৎ পরোক্ষ কর ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। তার সঙ্গে এখন প্রত্যক্ষ কর আয়কর বাড়ানোর আদেশ এল।

যদিও আয়করের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক রাজস্ব আদায় হবে না, পরের অর্থ বছরে এর ফল মিলবে; তবুও পরবর্তীকালে যে আদায় বাড়বে, আইএমএফকে সে বার্তা দিতে এখন এই পদক্ষেপ বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এই পদক্ষেপের আগে এই মাসের শুরুতে হঠাৎ করেই ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে এনবিআরের প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকার।

ওষুধ, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, জুস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাওয়া, বিমানের টিকেটসহ সিগারেট এবং তামাকপণ্য রয়েছে বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক-করের তালিকায়।

এসব পণ্যে আগে ভ্যাট ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল। তা এখন ১৫ শতাংশ হওয়ায় বাজারে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ৪ জানুয়ারি এনবিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেই বলা হয়েছিল, ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক এবং আবগারি শুল্কের হার ও পরিমাণ ‘যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে’ রাজস্ব আহরণ বাড়াতে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

সরকারের রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে ভ্যাট। বর্তমানে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিয়ে থাকে।

এর বাইরে এখনও লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতার আনতে এনবিআরের কার্যকর উদ্যোগ কম। এমনকি ভ্যাট আদায় বাড়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসও (ইএফডি) বসাতে পারেনি সংস্থাটি।

গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকায় আনা হলেও শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ভ্যাট আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা।

হিসাব করে দেখা যায়, গত অর্থ বছরে মোট রাজস্বের ৪০ দশমিক ৪৫ শতাংশই আদায় হয়েছিল ভ্যাট থেকে।

চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্য ধরা আছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট রাজস্বের ৩৮ দশমিক শূন্য আট শতাংশ ভ্যাট থেকে আসবে।

ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে পরবর্তী

ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে

কমেন্ট