প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশে নামবে, চড়াই থাকবে মূল্যস্ফীতি : বিশ্বব্যাংক

প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশে নামবে, চড়াই থাকবে মূল্যস্ফীতি : বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি (২০২৫) সংস্করণে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থাটি বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। আর এতে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতি চড়াই  থাকবে। সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না।

বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি (২০২৫) সংস্করণে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসেতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তর থেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। এর ফলে গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে।

গত জুনে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। হিসাব বলছে, জুনের চেয়ে জানুয়ারির পূর্বাভাস ১ দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়েছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নামতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কম। জ্বালানি সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন শিল্পে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। এটা আবার মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে গত আওয়ামী লীগ সরকার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসেবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সরকারি লক্ষ্যের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী কমে গেলে তা হবে কোভিড মহামারির পর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংক বলেছে, তাদের প্রাক্কলন হলো গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ। গত বছরের ক্ষেত্রেও তার নিম্নমুখী সংশোধন এনেছে। বিশ্বব্যাংকের আগের প্রাক্কলন ছিল, গত অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

একটি দেশের ভেতরে যত পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তা–ই জিডিপি। আগের বছরের চেয়ে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে বলা হয় প্রবৃদ্ধি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মানে হলো, অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়া। এতে আগের চেয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমে যায়। বেকার বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়। ব্যবসা–বাণিজ্য দ্রুতগতিতে না বাড়লে, কারখানায় উৎপাদন না বাড়লে মানুষের আয় বৃদ্ধির সুযোগ কমে যায়। দেশে তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ।

বাংলাদেশে সাধারণত ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়। ২০২১–২২ অর্থবছরে হয়েছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নামে। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।

যদিও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হতো।

বিশ্বব্যাংক যেমন জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলেছে, তেমনি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঁচটি ঝুঁকির কথা বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত তাদের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তুলে ধরা ঝুঁকিগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া (বন্যা, তাপপ্রবাহ), দূষণ (বায়ু, পানি, মাটি), বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা (মন্দা, স্থবিরতা)। এই ঝুঁকি তারা চিহ্নিত করেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের ওপর জরিপ করে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নামতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশীয় বিন্দু কম। জ্বালানি সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন শিল্পে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলেছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। এটা আবার মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে।

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। তবে দেশ দুটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে আড়াই শতাংশ। নেপালও ভালো করবে। ভারতে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল–মার্চ) জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে বিনিয়োগে মন্থরতা ও উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায়।

বাংলাদেশে চলতি বছর জিপিডির প্রবৃদ্ধি কমলেও আগামী অর্থবছরে (২০২৫–২৬) তা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিস্থিতির আরও উন্নতির আশা আছে। সঙ্গে আর্থিক খাতে সংস্কার হতে পারে, ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হতে পারে এবং বাণিজ্য বাড়বে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ভারতে ৬ দশমিক ৭, পাকিস্তানে ২ দশমিক ৮, শ্রীলঙ্কায় (২০২৫) ৩ দশমিক ৫ এবং নেপালে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশেই চড়া

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এলেও বাংলাদেশে কমছে না; কমার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এই মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপ ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি হয়নি; বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ।

সংস্কার নয়, অর্থনীতি অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা উচিত: রেহমান সোবহান পরবর্তী

সংস্কার নয়, অর্থনীতি অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা উচিত: রেহমান সোবহান

কমেন্ট