মহার্ঘ ভাতার কথা অর্থ উপদেষ্টা ‘জানেন না’

মহার্ঘ ভাতার কথা অর্থ উপদেষ্টা ‘জানেন না’

অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংগ্রহে বড় ঘাটতির মধ্যে পড়ায় মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটছে বলে গত কয়েকদিন ধরে গুঞ্জন চলছিল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেই সরকারি কর্মচারীদের যে মহার্ঘ ভাতার সুখবর দিয়েছিল, তা এখন দৃশ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

মহার্ঘ ভাতা দিলে অর্থ সংস্থানের দায়িত্ব যার ওপর পড়বে, সেই অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ দাবি করছেন, তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।

অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংগ্রহে বড় ঘাটতির মধ্যে পড়ায় মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটছে বলে গত কয়েকদিন ধরে গুঞ্জন চলছিল।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকরা অর্থ উপদেষ্টার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকার এ বিষয়ে কখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এর ঘোষণা হয়নি। মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়ে কে ঘোষণা দিয়েছে, আমি জানি না।”

অথচ গত ১৫ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে মহার্ঘ ভাতার খবর দিয়েছিলেন।

সেদিন তিনি কথা শুরু করেছিলেন এভাবে- “সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন, তাদের জন্য একটি সুখবর দিতে চাই।”

এরপর তিনি বলেছিলেন, “যেহেতু পে কমিশন করা একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। অন্তর্বর্তী সময়ে একটি মহার্ঘ ভাতা কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে আমিও আছি।”

গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর আওতাভুক্ত কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করতে মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের কমিটি গঠিত হয়।

অর্থ উপদেষ্টা এখন এই বিষয়টি তার অজানা থাকার কথা বললেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উপসচিব সৈয়দ আলী বিন হাসান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে ওই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় অর্থ বিভাগেরই একজন অতিরিক্ত সচিবকে।

এরমধ্যে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ কমায়। সেই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ডিসেম্বর মাসেই বলেছিলেন, “সরকারি কর্মচারীদের বহু ধরনের দাবি-দাওয়া মেটাতে গিয়ে কিছু কিছু বেতন-ভাতা, মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর বিষয় আছে। কাজেই রাজস্ব খাতে ব্যয় কমিয়ে রাখা খুব কঠিন।”

অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় অর্থের পাশাপাশি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও ছিল সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিনের কাছে। পরে ওই দপ্তর অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিনকে দেওয়া হয়।

রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিশাল অঙ্ক পিছিয়ে থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছয় মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি রয়েছে ৫৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।

দেশে মূল্যস্ফীতি যখন চড়া, তখন সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে তা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে আসছিলেন।

অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীরা বলছে, ২০১৫ সালের পর তাদের আর নতুন বেতন কাঠামো না আসায় বর্তমান বাজারে তাদের চলতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৪ লাখের মতো। এই তথ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। এর সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ অন্যদের নিয়ে সরকারকে প্রায় ২২ লাখ চাকুরের বেতন-ভাতা দিতে হয়।

সরকারি কর্মচারীদের ২০১৫ সালে নতুন পে স্কেল ঘোষণার পর পাঁচ বছর পর আবার বেত বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। শুধু গত বছরের জুলাই থেকে ‘বিশেষ সুবিধা’ হিসাবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ করে অতিরিক্ত বেতন পাচ্ছেন তারা।

কতদূর এগিয়েছিল সরকার

গত ১১ ডিসেম্বরের অফিস আদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের কর্মে নিয়োজিত জাতীয় বেতন স্কেল, ২০১৫-এর আওতাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুকূলে মহার্ঘ ভাতার সংস্থানের বিষয়টি পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এ কমিটি গঠন করা হলো।

কমিটির সদস্য সচিব করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রবিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জ্যেষ্ঠ সচিব, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব।

কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, কমিটি মহার্ঘ ভাতার প্রযোজ্যতা ও প্রাপ্যতার বিষয় পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ দাখিল করবে। কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক কর্মকর্তাকে কো-অপ্ট করতে পারবে।

এরপর জনপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস বলেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে; কত শতাংশ, তা ঠিক হবে কমিটির সুপারিশে।

এই সুবিধা পেনশন ভোগ করা অবসরপ্রাপ্তরাও পাবেন বলে জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন সচিব।

তিনি আরও বলেছিলেন, “পিয়ন থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত সবাই এই মহার্ঘ ভাতা পাবেন। তবে এর দুটি ধাপ হতে পারে। এর মধ্যে কর্মকর্তাদের জন্য একটু কম এবং কর্মচারীদের জন্য একটু বেশি দেওয়া হতে পারে।”

সর্বোচ্চ ধাপ ও সর্বনিম্ন ধাপ এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ধাপ কীভাবে ঠিক করা হবে, তার কৌশল বের করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

তখন সাংবাদিকরা স্পষ্ট হতে জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেসের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সরকার কি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?

জবাবে তিনি বলেছিলেন, “অবশ্যই। মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে বলেই তো কমিটি করা হয়েছে। কত শতাংশ দেওয়া হবে, সেটি এই কমিটি সুপারিশ করবে।”

মূল্যস্ফীতি

সাধারণত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে গেলে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়। এতে মূল বেতনের হারে একটি অঙ্ক বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত হিসাবে দেওয়া হয়। ফলে মাসিক বেতন বাড়ে।

সরকারি কর্মচারীরা মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন বেতন কাঠামো কিংবা মহার্ঘ ভাতা দাবি করে এলেও তাদের বেতন বাড়লে তার প্রভাবে যে আবার বাজারে পণ্যের দাম চড়বে, তা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মূল্যস্ফীতি গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরে দুই অঙ্কের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তার মধ্যে খাদ্যে ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

মহার্ঘ ভাতা যে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে, অর্থনীতিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক মহল থেকেও সতর্ক করা হচ্ছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১৮ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সংকট তৈরি করবে এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে।”

এনবিআরকে শুধু কর আদায়ে রাখার সুপারিশ পরবর্তী

এনবিআরকে শুধু কর আদায়ে রাখার সুপারিশ

কমেন্ট