অর্থনীতি উদ্ধারে দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন: সিপিডি
সংস্থাটি বলেছে, দেশের অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনার জন্যই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরা প্রয়োজন। সেই কারণে দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন।
এতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ আসছিল, এখন তাতে যোগ দিল অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডিও।
সংস্থাটি বলেছে, দেশের অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনার জন্যই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরা প্রয়োজন। সেই কারণে দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
সেই সরকারের পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ খরায় অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
গণতন্ত্রে ফেরার জন্য বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও অন্তর্বর্তী সরকার জোর দিচ্ছে সংস্কারে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ন্যূনতম সংস্কার শেষে এই বছরের শেষ দিকে নির্বাচন দেওয়া যেতে পারে। আর ব্যাপক সংস্কার শেষে নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে।
বুধবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। আমরা চাই, সরকার ঘোষিত রোডম্যাপের মধ্যেই নির্বাচন হোক। যত দ্রুত সম্ভব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।”
‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৪-২৫: সংকটময় সময় প্রত্যাশা পূরণের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ দ্রুত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল কর্মসংস্থানের অভাব। বিগত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বেকারত্ব বাড়িয়ে তুলেছিল। সমাজে বৈষম্য বেড়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভবপর নয়। ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনৈতিক গতিধারার উন্নতি নেই। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। গত বছর একই সময় তা ছিল ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের অবনতি হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগে দৃশ্যমান কোনও উন্নতি না দেখার কথাও বলেন তিনি।
ফাহমিদা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সফলতা এখনো দেখা যায়নি।
মোস্তাফিজুর রহমান রাজস্ব আয় সংস্থানে সরকারের ভ্যাট বাড়ানোর পদক্ষেপের সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, “সরকার এমন সময়ে ভ্যাট বাড়াচ্ছে, যে সময়ে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট। মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ এসেছিল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। তারা পরোক্ষ করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
“জনগণ যে কর দেয়, সরকার তা পুরোপুরি পায় না। সরকারের সুযোগ ছিল এসব জায়গায় হাত দেওয়ার, কিন্তু দেয়নি।”
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপেই সরকার রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে ভ্যাট বাড়ানোর দিতে নজর দিয়েছে বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর।
ফাহমিদা খাতুন সরকারের রাজস্ব আদায়ের কৌশল নিয়ে বলেন, কর বাড়াতে হবে। সেজন্য ভ্যাট নয়, প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে। করের অর্থ ভালোভাবে ব্যয় করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করতে হবে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কথাও বলা হয় সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে। সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, জ্বালানি নিয়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে। সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে। এজন্য আগের চুক্তি বাতিল করে ‘বিদ্যুৎ নেই, টাকা নেই’ নীতিতে যেতে হবে।
পাশাপাশি জ্বালানির নতুন উৎস বের করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, গ্যাস কূপ খননে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত সরকার আমলে স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিপত্র প্রকাশের দাবি জানান ফাহমিদা।
২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি চেয়ে সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিল সিপিডি। তবে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে- এই যুক্তি তুলে ধরে সেই তথ্য অন্তর্বর্তী সরকার দেয়নি বলে জানান ফাহমিদা।
দুর্দশায় পড়ার ব্যাংক খাত নিয়ে তিনি বলেন, “দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত কিছু ব্যাংক নাজেহাল দশায় রয়েছে।
“এসব ব্যাংক লাইফ সাপোর্টে, গ্রাহকরা ঝুঁকিতে। এসব ব্যাংকের অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা নেই। এজন্য সার্বিক দিক বিবেচনায় লাইফ সাপোর্টে রাখা ব্যাংক বন্ধ করা যেতে পারে।”
খেলাপি ঋণ কমাতে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ব্যাংক হিসাব জব্দের সুপারিশ দিয়েছে সিপিডি।
ফাহমিদা বলেন, “প্রয়োজনে দেউলিয়া আইন পরিবর্তন করতে হবে। বিকল্প নিষ্পত্তি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়াতে হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “চাঁদাবাজি এখনও চলছে। পণ্য সরবরাহে বেশি হাতবদলের কারণে খরচ বাড়ছে, যা কার্যত ভোক্তাকে বহন করতে হচ্ছে।”
দেবপ্রিয় নেতৃত্বাধীন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ফাহমিদা বলেন, “পাচার অর্থ ফেরত আনার কাজ বাংলাদেশই প্রথম করছে না। বিশ্বে আরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকার সেপথে আগাতে পারে।
“এজন্য বিএফআইইউকে শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। সাবেক গভর্নরসহ যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।”
নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকার ব্যর্থ
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাঁদাবাজি বন্ধ ও মজুতদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবিলা করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী ও জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ফাহমিদা বলেন, সিপিডির পর্যবেক্ষণে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে।
“বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুতদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ এবং পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া।”
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত জটিল। সে কারণে সিপিডি চালের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা নিরূপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মাঝারি-পাইজাম চাল। যার লক্ষ্য ছিল প্রধানত দামের যে অস্থিরতা তার মূল কারণগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করা।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটো রাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধান চাষীরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
সিপিডি বলছে, অর্থনীতিতে মুল্যস্ফীতির চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছে এবং নীতি সুদহারও বৃদ্ধি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের উপর উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির বোঝা কমাতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সরবরাহ-পক্ষীয় ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করেছে, যেমন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করা এবং ঢাকার ভেতরে ও বাইরে ন্যায্য মূল্যের বাজার প্রতিষ্ঠা করা।
তবে দুঃখের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে চাঁদাবাজি, মজুদদারি বা অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মতো অনিয়ম মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলি এখনও পর্যন্ত বাজারে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটি আরও বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।
সিপিডির গবেষণা ফেলো মুনতাসির কামাল, সৈয়দ ইউসুফ সাদাতও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
কমেন্ট