দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৪৮ শতাংশ
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথ গতির কারণে প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায়, বিশেষ করে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়েছে; ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথ গতির কারণে প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায়, বিশেষ করে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থ বছরের তিন প্রান্তিক (নয় মাস, জুলাই-সেপ্টেম্বর, অক্টোবর-ডিসেম্বর ও জানুয়ারি-মার্চ) শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার দ্বিতীয় প্রান্তিকের (তিন মাস, অক্টোবর-ডিসেম্বর) জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
কৃষি, শিল্প ও সেবা- এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এই তিন খাতেই প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শিল্প খাতে।
অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ; প্রথম প্রান্তিকে হয়েছিল ২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দশমিক ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা বেড়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ হয়েছে।
বিবিএসের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের সার্বিক চিত্র খুবই হতাশাজনক। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখা যাক, বাকি দুই প্রান্তিক কেমন যায়। যদি দ্বিতীয় প্রান্তিকের মতোও যায়, তাহলে অর্থ বছর শেষে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের উপরে থাকবে।”
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে চূড়ান্ত হিসাবে দেশে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
জুলাইয়ে কোটাবিরোধী ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন হয়, তা ঠেকাতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করা হয়। তখন চলাচল সীমিত করা হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যায়। এরই এক পর্যায় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়; ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্টের এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল দুই সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। কিছুদিন আগে এই তিন উন্নয়ন সংস্থাই বলেছে, অনিশ্চয়তার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) অনেক কমবে।
আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। তবে সংস্থাটি মনে করে যে আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে।
বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। এডিবি বলেছে, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল শেখ হাসিনার সরকার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে দেশের ভেতরে স্থিরমূল্যে ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়, যা গত ছয় প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ওই প্রান্তিকেও সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শিল্প খাতে। সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর কৃষি খাতে দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে চলতি অর্থ বছরে যদি ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্জিত হয়, সেটাও আমি ভালো বলে মনে করি। কেননা, একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দেশে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বিনিয়োগ। সহসা ভালো হওয়ারও কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “এরই মধ্যে ট্রাম্পের শুল্ক ধাক্কা লেগেছে দেশে। এই ধাক্কায় রপ্তানি আয় কমে গেছে তার নেতিবাচক প্রভাব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পড়বে। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা।”
আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণের তিন কিস্তি ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার। আগামী জুনে দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) অর্থ এক সঙ্গে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার।
এই ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমশক্তি জরিপও প্রান্তিকভিত্তিক করতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিকভিত্তিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ শুরু হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক থেকে ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে বিবিএস।
তার আগে পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থ বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেওয়া হত। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব।
সে হিসাবেই গত বছরের ২১ মে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে বলে জানানো হয়।
পরে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করে বিবিএস। তাতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
কমেন্ট