যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি, কমেছে আমিরাত থেকে
১৫ বছরে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জ্বালাও–পোড়াও, সংঘাত-সহিংসতা, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নে এই বেহাল দশা বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর দেশের ভিন্ন পেক্ষাপটে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে কচ্ছপগতি দেখা দিয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দের ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
বাস্তবায়নের এই হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিন্ম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এডিপিতে মোট বরাদ্দের ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এডিপি বাস্তবায়নের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জ্বালাও–পোড়াও, সংঘাত-সহিংসতা, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়নে এই বেহাল দশা বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
আইএমইডি’র ওয়েবসাইটে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায় ওই অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এর থেকে কম এডিবি বাস্তবায়ন হয়নি।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে সরকার পতনকে কেন্দ্র করে জুলাই-অগাস্ট জুড়ে জ্বালাও পোড়াওয়ের পর এডিপি বাস্তবায়নে ধস নামে।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দেয়। আগের সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে চলমান অনেক প্রকল্পের কাজও স্থবির হয়ে যায়। এসব মিলিয়ে এডিপির বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় কমে যায় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
সাধারণত অর্থবছরের প্রথমদিকে এডিপির ব্যয়ের পরিমাণ কম থাকে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার তা আরও কমে গেছে।
একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ী নীতির প্রভাবও পড়েছে এডিপি বাস্তবায়নে। সরকার কম ব্যয়ের দিকে ধাবিত হয়ে এটি কাটছাঁটও করেছে। গত ৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপিতে টাকার অঙ্কে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া চলতি অর্থবছরের ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এডিপি কমিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করেছে। সবচেয়ে বেশি কমিয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দসহ ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার এডিপি চূড়ান্ত হয়েছিল। কমানোর পর এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয়ের বরাদ্দসহ আরএডিপির আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ২৬ হাজার ১২৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা; অর্থ্যাৎ কমেছে ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ৫২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
অর্থবছরের একেবারে প্রথমভাগে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে ধীর হয়ে পড়া উন্নয়ন কাজে ডিসেম্বরে কিছুটা গতি বাড়লেও পরের তিন মাসে তা আবার ধীর হয়ে পড়ার তথ্য দিচ্ছে এডিপির অর্থ ব্যয়।
আইএমইডির তথ্য বলছে, মার্চে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা মোট সংশোধিত এডিপির ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মার্চে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ; খরচ হয়েছিল ২২ হাজার ৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
ব্যয় ও বাস্তবায়ন হার- উভয় বিবেচনায়ই চলতি অর্থবছরের মার্চে এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি ৮ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এ হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সংশোধিত এডিবির ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রতিবারই অর্থবছরের সাত-আট মাসের মাথায় এসে মূল এডিপির আকার কমানো হয়ে থাকে; যেটাকে সংশোধিত এডিপি বলা হয়ে থাকে।
এর আগের ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ সময়ে সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ, ৪৫ দশমিক ০৫শতাংশ এবং ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে প্রথমে সরকারিতে চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং পরে সরকার পতনেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সারাদেশ অচল হয়ে পড়লে মুখ থুবড়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। এর রেশ পড়ে চলমান প্রকল্পের কাজেও।
অগাস্টে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়ে সরকারের পতন ঘটায়। তিন দিন কার্যত সরকার শূন্য থাকার পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাল ধরে ৮ আগস্ট।
এরপর আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পের কী হাল হবে তা নিয়ে বিদেশি সংস্থার মাঝেও দানা বাঁধে শঙ্কা। এর মাঝে আমলাতন্ত্র নতুনভাবে সাজাতে যেয়ে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির মাঝে দায়িত্বরত প্রকল্প পরিচালকরাও নির্দেশনার অভাবে ঢিমেতালে সময় পার করেন।
আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ও নানা শঙ্কায় গা ঢাকা দেন প্রকল্পের ঠিকাদাররাও; এতে পুরোপুরি থমকে যায় প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিফলন পরিসংখ্যানেও পাওয়া যাবে অনুমেয়ই ছিল, হালনাগাদ তথ্যে সেটিই পাওয়া যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম একনেক সভায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগের সরকারের ‘রাজনৈতিক কারণে’ নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনার কথা বলেন।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলেছিলেন, “বিগত সরকারের সময়ে একনেক সভায় বিপুল সংখ্যক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের গতি এক থাকত না।
“অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রকল্পও থাকত। এখন সেসব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কাজেই আগে একনেক সভা মানেই যেখানে অর্থ ব্যয়ের কর্মযজ্ঞ ছিল, এখন সে পরিধি কমে আসবে।”
এডিপি বাস্তবায়নের বেহাল দশা নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে বিদায়ী সরকারও কৃচ্ছসাধনের পথ বেছে নিয়েছিল।
“এরই মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই ঘিরে আন্দোলন, নৈরাজ্য আর আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলে তৈরি হওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে থমকে যাওয়া উন্নয়ন কাজের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
কমেন্ট